না বলতে শিখুন: সুস্থ বাউন্ডারি তৈরির গাইডলাইন

Learn to say No

আমরা অনেকেই আছি যারা অন্যের অনুরোধে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও 'হ্যাঁ' বলে ফেলি। মনে মনে হয়তো চাইছি কাজটি না করতে, কিন্তু মুখ ফুটে 'না' শব্দটি বের হয় না। পরবর্তীতে নিজের ওপর রাগ হয়, ক্লান্তি আসে এবং মানসিক চাপ বাড়ে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'পিপল প্লিজার' সিনড্রোম বা সবাইকে খুশি করার প্রবণতা।

কিন্তু কেন আমরা 'না' বলতে পারি না? আর কেনই বা জীবনে সুস্থ বাউন্ডারি বা সীমানা তৈরি করা জরুরি? 

আজকের এই লেখায় আমরা এই মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো এবং বাউন্ডারি তৈরির বৈজ্ঞানিক উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

১. কেন আমরা 'না' বলতে পারি না?

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, 'না' বলতে না পারার পেছনে বেশ কিছু গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে:

প্রত্যাখ্যানের ভয়: আদিম যুগে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে থাকত। দল থেকে বাদ পড়া মানেই ছিল মৃত্যু। সেই বিবর্তনীয় ভয় আমাদের অবচেতন মনে আজও রয়ে গেছে। আমরা ভাবি, 'না' বললে হয়তো সম্পর্ক নষ্ট হবে বা আমরা একঘরে হয়ে পড়ব।

অপরাধবোধ: ছোটবেলা থেকে অনেককে শেখানো হয় যে, অন্যের উপকার করাই মহৎ গুণ। ফলে নিজের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিলে আমাদের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করে। মনে হয়, আমি বোধহয় স্বার্থপর।

কনফ্লিক্ট এড়ানো: অনেকে মতবিরোধ বা তর্ক এড়াতে চান। তারা ভাবেন, এখন 'হ্যাঁ' বলে দিলে পরিস্থিতি শান্ত থাকবে, যদিও দীর্ঘমেয়াদে এটি তার নিজের জন্যই অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

FOMO (Fear Of Missing Out): অনেক সময় আমরা মনে করি, 'না' বললে হয়তো কোনো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

২. বাউন্ডারি বা সীমানা আসলে কী?

সহজ কথায়, বাউন্ডারি হলো একটি অদৃশ্য রেখা যা আপনার নিজের দায়িত্ব এবং অন্যের দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। এটি স্বার্থপরতা নয়; বরং এটি হলো 'আত্ম-সুরক্ষা'।

একটি বাড়ির যেমন দেয়াল থাকে, যা বাড়ির ভেতরের মানুষকে নিরাপদ রাখে, তেমনি মানসিক বাউন্ডারি আপনার আবেগ, সময় এবং শক্তিকে সুরক্ষিত রাখে। বাউন্ডারি থাকলে আপনি জানেন যে, অন্যের আবেগের দায়িত্ব আপনার নয় এবং আপনার সুখের দায়িত্ব অন্যের নয়।

৩. সুস্থ বাউন্ডারি না থাকার পরিণতি

যখন আপনি বারবার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে 'হ্যাঁ' বলেন, তখন নিজের অজান্তেই আপনি কিছু মানসিক ক্ষতির শিকার হন:

বার্নআউট: অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়ার ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি নিঃশেষ হয়ে পড়েন।

বিরক্তি ও ক্ষোভ: যার কাজ আপনি করছেন, তার প্রতি আপনার মনে গোপন ক্ষোভ তৈরি হয়। মনে হতে থাকে, "সে কেন আমার সময়ের মূল্য দিচ্ছে না?"

আত্মসম্মান কমে যাওয়া: নিজের প্রয়োজনকে অবহেলা করতে করতে একসময় মনে হয়, আপনার নিজের কোনো মূল্য নেই।

৪. কীভাবে তৈরি করবেন সুস্থ বাউন্ডারি?

'না' বলা একটি শিল্প। এটি শেখার জন্য প্র্যাকটিস করতে হয়। নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:

নিজের মূল্যবোধ চিনুন: প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার কাছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কী? পরিবার, ক্যারিয়ার, বিশ্রাম, নাকি মানসিক শান্তি? যখন আপনি জানবেন আপনার প্রায়োরিটি কী, তখন অপ্রয়োজনীয় অনুরোধে 'না' বলা সহজ হবে।

সময় নিন: কেউ কোনো অনুরোধ করলে সাথে সাথে উত্তর দেবেন না। বলুন, "আমি একটু ক্যালেন্ডার চেক করে তোমাকে জানাব" বা "আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও।" এই বিরতি আপনাকে আবেগের বশবর্তী হয়ে 'হ্যাঁ' বলা থেকে আটকাবে এবং যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দেবে।

অজুহাত দেবেন না: 'না' বলার সময় আমরা প্রায়ই বড় বড় ব্যাখ্যা দিতে শুরু করি। মনে রাখবেন, 'না' নিজেই একটি সম্পূর্ণ বাক্য।

ভুল পদ্ধতি: "আসলে আমার খালা অসুস্থ, আবার আমার গাড়িটাও নষ্ট, তাই যেতে পারব না..." (এতে মনে হয় আপনি মিথ্যা অজুহাত দিচ্ছেন)।

সঠিক পদ্ধতি: "দুঃখিত, আমি এই সপ্তাহে খুব ব্যস্ত। আমার পক্ষে আসা সম্ভব হচ্ছে না।"

স্যান্ডউইচ মেথড: যদি সরাসরি 'না' বলতে খারাপ লাগে, তবে এই সাইকোলজিক্যাল ট্রিকটি ব্যবহার করুন। দুই পাশে পজিটিভ কথা এবং মাঝখানে 'না'।

পজিটিভ: বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

না: কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমি সেদিন উপস্থিত থাকতে পারব না।

পজিটিভ: আশা করি তোমাদের অনুষ্ঠানটি খুব সুন্দর হবে।

ছোট ছোট পদক্ষেপে শুরু করুন: হঠাৎ করে বসের মুখের ওপর বা খুব কাছের বন্ধুর মুখের ওপর 'না' বলা কঠিন। তাই অপরিচিত বা কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্র্যাকটিস শুরু করুন। যেমন: দোকানদার কিছু কিনতে জোর করলে ভদ্রভাবে 'না' বলুন, বা ফোনে কোনো অফার আসলে সরাসরি মানা করুন।

শেষ কথা 

'না' বলা মানে নিজেকে 'হ্যাঁ' বলা। অন্যকে 'না' বলা মানেই হলো নিজের মানসিক স্বাস্থ্য, নিজের সময় এবং নিজের লক্ষ্যগুলোকে 'হ্যাঁ' বলা। প্রথমদিকে এটি অস্বস্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু ধীরে ধীরে আপনি অনুভব করবেন যে, সুস্থ বাউন্ডারি আপনার সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত এবং স্বচ্ছ করছে। যারা আপনাকে ভালোবাসে, তারা আপনার বাউন্ডারিকে সম্মান করবে। আর যারা করবে না, তাদের আপনার জীবনে কতটুকু প্রয়োজন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

সুস্থ বাউন্ডারি তৈরি করুন, ভালো থাকুন। কারণ, আপনি ভালো থাকলেই কেবল অন্যদের ভালো রাখতে পারবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url