হোয়াই নেশনস ফেইল: কেন কোনো দেশ ধনী আর কোনো দেশ গরিব?

Why Nations Fail

আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলো এত উন্নত কেন, আর আফ্রিকা বা এশিয়ার অনেক দেশ এখনো এত পিছিয়ে কেন? ছোটবেলা থেকে আমরা এর অনেক কারণ শুনেছি, হয়তো তাদের আবহাওয়া ভালো, অথবা তাদের সংস্কৃতি উন্নত, কিংবা তাদের শাসকরা বেশি জ্ঞানী।

কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমোগলু এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস রবিনসন তাদের 'হোয়াই নেশনস ফেইল' বইয়ে এই প্রচলিত ধারণাগুলো পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছেন। তাদের মতে, একটি দেশের ভাগ্যের চাবিকাঠি আবহাওয়া বা সংস্কৃতি নয়, বরং সেই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

আজকের এই লেখায় আমরা এই বইটির মূল তত্ত্বগুলো সহজ ভাষায় আলোচনা করব।

১. মূল পার্থক্য: ইনক্লুসিভ বনাম শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান

রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তারা কোন পথটি বেছে নিচ্ছে তার ওপর।

ইনক্লুসিভ ইস্টিটিউট: এই ব্যবস্থায় দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। এখানে আইনের শাসন থাকে, সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং মেধার ভিত্তিতে উপরে ওঠার সুযোগ থাকে। যেমন: দক্ষিণ কোরিয়া বা আমেরিকা। এসব দেশে মানুষ ইনোভেশনে উৎসাহিত হয়, কারণ তারা জানে তাদের পরিশ্রমের ফল কেউ কেড়ে নেবে না।

শোষণমূলক ইস্টিটিউট: এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মুষ্টিমেয় কিছু শাসক বা এলিট শ্রেণী। তারা এমন নিয়মকানুন তৈরি করে যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সম্পদ শোষণ করে নিজেদের পকেট ভারি করা যায়। এখানে নতুন কোনো উদ্যোগ বা ব্যবসাকে বাধা দেওয়া হয়, যাতে শাসকদের একচেটিয়া ক্ষমতা বা মনোপলি নষ্ট না হয়। যেমন: উত্তর কোরিয়া বা জিম্বাবুয়ে।

২. প্রচলিত মিথ 

বইটিতে লেখকরা অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে তিনটি প্রচলিত ভুল ধারণা তুলে ধরেছেন:

ক. ভৌগোলিক তত্ত্ব: অনেকে বলেন, শীতপ্রধান দেশের মানুষ বেশি কর্মঠ হয়, তাই তারা ধনী। আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ অলস হয়। কিন্তু নোগালেস শহরের বাস্তবতা ভিন্ন। একটি প্রাচীর দিয়ে শহরটি দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তরের অংশ আমেরিকার অ্যারিজোনায়, সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, শিক্ষার হার বেশি, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত। দক্ষিণের অংশ মেক্সিকোর সোনোরায়, সেখানে দারিদ্র্য ও অপরাধ বেশি। একই আবহাওয়া, একই ভৌগোলিক অবস্থান, কিন্তু শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভিন্নতার কারণে দুই অংশের মানুষের জীবনযাত্রা আকাশ-পাতাল তফাৎ।

খ. সাংস্কৃতিক তত্ত্ব: অনেকে মনে করেন, নির্দিষ্ট কিছু ধর্ম বা সংস্কৃতির মানুষ উন্নতির জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু বাস্তব প্রমাণ হলো উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া। তাদের ইতিহাস এক, ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দেশভাগের পর দক্ষিণ কোরিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ পথ বেছে নিয়ে আজ বিশ্বমঞ্চে ধনী রাষ্ট্র, আর উত্তর কোরিয়া শোষণমূলক বা এক্সট্র্যাক্টিভ শাসনের কারণে অন্ধকারে নিমজ্জিত। এখানে সংস্কৃতি নয়, রাজনীতিই মুখ্য।

গ. অজ্ঞতা তত্ত্ব: অনেকে ভাবেন, গরিব দেশের শাসকরা জানেন না কীভাবে অর্থনীতি ঠিক করতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো শাসকরা বোকা নন। তারা জানেন কীভাবে দেশের উন্নতি করা সম্ভব। কিন্তু তারা ইচ্ছাকৃতভাবে তা করেন না। কারণ, দেশের উন্নতি বা সবার জন্য সুযোগ তৈরি করতে গেলে তাদের নিজেদের একচেটিয়া ক্ষমতা ও লুটপাটের সুযোগ কমে যাবে। এটি তাদের পলিটিক্যাল চয়েস, অজ্ঞতা নয়।

৩. সৃজনশীল ধ্বংসের ভয়

অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন উদ্যোগ। অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার একে বলেছেন ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশন। যেমন, উবার আসার ফলে সাধারণ ট্যাক্সি ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু যাত্রীদের লাভ হয়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে।

শোষণমূলক রাষ্ট্রে শাসকরা এই পরিবর্তনকে ভয় পায়। কারণ নতুন প্রযুক্তি বা নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রযুক্তি ও শিক্ষাকে আটকে রাখে। একসময় অটোমান সাম্রাজ্য বা রুশ জারেরা রেললাইন বা ছাপাখানা বসাতে বাধা দিয়েছিল শুধুমাত্র ক্ষমতা হারানোর ভয়ে।

৪. ইতিহাসের বাঁক বদল 

কেন ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব হলো কিন্তু অন্য কোথাও হলো না? লেখকরা একে বলেন ক্রিটিকাল জাঙ্কচার বা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। ১৬৮৮ সালের গ্লোরিয়াস বিপ্লব ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেখানে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে পার্লামেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত হয়, যা মানুষকে নতুন নতুন কলকারখানা তৈরিতে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, স্পেন বা ফ্রান্সে রাজারা তখনও সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন, ফলে তারা পিছিয়ে পড়েন।

৫. একটি সতর্কবার্তা: ভেনিসের পতন

একসময় ভেনিস ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধ নগরী। কিন্তু যখন ভেনিসের ধনী বণিকরা দেখল নতুনরা এসে তাদের ব্যবসার ভাগ বসাচ্ছে, তারা আইন করে নতুনদের ব্যবসা ও রাজনীতিতে আসা নিষিদ্ধ করে দিল। একে বলা হয় "La Serrata" বা দরজা বন্ধ করা। এরপর থেকেই ভেনিস ধীরে ধীরে একটি মৃত শহরে পরিণত হলো। এটি আমাদের শেখায় যে, একটি দেশ ধনী হলেও যদি তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইনক্লুসিভ না রেখে শোষণমূলক করে ফেলে, তবে তাদের পতন অনিবার্য।

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র

গত কয়েক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং পদ্মা সেতু বা মেট্রো রেলের মতো দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও, এই উন্নয়ন কতটুকু টেকসই তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কোনো দেশে যদি শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান থাকে, তবে সেখানে স্বল্পমেয়াদী প্রবৃদ্ধি হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা টিকে থাকে না।

বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব এবং ধনী দরিদ্রের ক্রমবর্মান বৈষম্য থেকে বুঝা যায় যে, অর্থনৈতিক সুফল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে। একে রিগড সিস্টেম বলা হয়, যেখানে সাধারণ উদ্যোক্তাদের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বেশি সুবিধা পায়। বাংলাদেশ এখন একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের এই সময়ে যদি আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন ও শক্তিশালী না করা হয় এবং অর্থনীতিকে সবার জন্য উন্মুক্ত বা ইনক্লুসিভ না করা হয়, তবে দেশটি মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই সত্যিকারের সমৃদ্ধির জন্য শুধু বড় স্থাপনা নয়, বরং শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

শেষ কথা

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন সেই তুলনায় পিছিয়ে আছে। টেকসই সমৃদ্ধির জন্য এখন প্রয়োজন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে গুটিকতক মানুষ নয়, বরং দেশের প্রতিটি নাগরিক অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর সুযোগ পাবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url