আর্ট অ্যান্ড ইন্টিমেসি

Art and Intimacy

আমরা সচরাচর আর্ট বলতে কী বুঝি? হয়তো মিউজিয়ামে সাজানো দামী কোনো পেইন্টিং, অপেরা হাউসের গান, কিংবা বিশাল বাজেটের কোনো সিনেমা। আমরা ধরে নিই, শিল্প হলো সভ্যতার এক চরম উৎকর্ষ, যা কেবল কিছু বিশেষ মানুষের কাজ। কিন্তু বিবর্তনীয় গবেষক অ্যালেন ডিসানায়াক তাঁর বিখ্যাত বই 'আর্ট অ্যান্ড ইন্টিমেসি' তে এই ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, শিল্প কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের টিকে থাকার একটি জন্মগত প্রবৃত্তি। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর কথা হলো পৃথিবীতে শিল্পের উদ্ভব হয়েছে মায়ের সাথে শিশুর ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে।

আজকের এই লেখায় আমরা সেই গভীর মনস্তাত্ত্বিক জগতটিই ঘুরে দেখব।

শিল্প এবং ভালোবাসার একই উৎস

মানুষের মস্তিষ্ক এবং আবেগ এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে আমাদের একে অপরের সাথে যুক্ত থাকাটা অপরিহার্য। আদিম যুগে বন্য পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মানুষের দরকার ছিল দলবদ্ধতা। আর এই দলবদ্ধতার প্রথম পাঠ শুরু হয় মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক দিয়ে।

মা যখন তার অবুঝ শিশুর সাথে কথা বলেন, তখন তিনি নিজের অজান্তেই শিল্পের উপাদানগুলো ব্যবহার করেন। খেয়াল করে দেখবেন: মা যখন শিশুর সাথে কথা বলেন, তার গলার স্বর স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু এবং সুরালো হয়। তিনি বারবার একই শব্দ বা ছড়া ব্যবহার করেন। তার মুখের ভঙ্গি অতিরঞ্জিত এবং নাটকীয় হয়।

এই যে সুর, ছন্দ, এবং অভিব্যক্তির খেলা, এটাই হলো মানব ইতিহাসের প্রথম "মাল্টিমিডিয়া পারফর্মেন্স"। শিশু এবং মায়ের এই ছন্দময় আদান-প্রদান থেকেই কালক্রমে গান, কবিতা এবং নাচের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ, শিল্পের আদি উৎস হলো ভালোবাসা বা অন্তরঙ্গতা।

মেকিং স্পেশাল

বইটির অন্যতম শক্তিশালী ধারণা হলো "মেকিং স্পেশাল" বা বিশেষ করে তোলা। মানুষ স্বভাবতই তার চারপাশের সাধারণ জিনিসকে অসাধারণ বা বিশেষ করে তুলতে চায়।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা খুব গভীর। যখন আপনি কাউকে ভালোবাসেন, আপনি তাকে একটি সাধারণ উপহার দিলেও সেটি সুন্দর করে র‍্যাপ করে দেন, সাথে একটি চিরকুট দেন। কেন? কারণ আপনি বোঝাতে চান যে ওই মানুষটি আপনার কাছে স্পেশাল।

ঠিক একইভাবে, আদিম মানুষ যখন কোনো হাতিয়ার বানাত, তারা সেটার গায়ে নকশা করত। যখন কোনো গল্প বলত, তারা সেটাকে সুর দিয়ে বলত। এই সাধারণ জিনিসটাকে স্পেশাল করে তোলার তাড়নাই হলো আর্ট। এটি আমাদের একঘেয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে এবং আমাদের দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।

আধুনিক সমাজ ও একাকীত্ব

ডিসানায়াক আধুনিক সমাজের একাকীত্বের জন্য আমাদের শিল্প থেকে বিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করেছেন। আজকাল আমরা শিল্পকে দৈনন্দিন জীবন থেকে আলাদা করে ফেলেছি। আমরা গান গাই না, গান শুনি; আমরা গল্প তৈরি করি না, নেটফ্লিক্সে দেখি। আমরা এখন অংশগ্রহণকারী নই, শুধুই দর্শক। আদিম সমাজে সবাই মিলে নাচত, গাইত বা রিচুয়াল পালন করত, যা তাদের মধ্যে অক্সিটোসিন বা 'বন্ডিং হরমোন' নিঃসরণ করত।

কিন্তু আধুনিক যুগে আমরা সেই "Shared Rhythm" বা সম্মিলিত ছন্দ হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের মধ্যে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা বোধ এবং বিষণ্ণতা।

শেষ কথা

শিল্পী হওয়ার জন্য আপনাকে প্রফেশনাল হতে হবে না, আপনার দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজগুলোকেও যদি আপনি যত্ন এবং ভালোবাসা দিয়ে স্পেশাল করে তুলতে পারেন সেটাই শিল্প।

দিনশেষে, শিল্প এবং ভালোবাসা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আমরা গান গাই, ছবি আঁকি বা সিনেমা বানাই, সবকিছুর মূলেই রয়েছে সেই আদিম আকাঙ্ক্ষা: অন্যের সাথে যুক্ত হওয়া এবং নিজের অস্তিত্বকে বিশেষ করে তোলা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url