ব্ল্যাক সোয়ান: অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রভাব ও আমাদের অজ্ঞতা
আপনি কি জানেন, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আবিষ্কারের আগে পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস করত যে সব রাজহাঁস সাদা? তাদের এই বিশ্বাস ছিল অটুট, কারণ তারা হাজার হাজার বছর ধরে কেবল সাদা রাজহাঁসই দেখে এসেছে। কিন্তু একদিন অস্ট্রেলিয়ায় একটি কালো রাজহাঁস দেখার পর সেই হাজার বছরের বিশ্বাস মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
নাসিম নিকোলাস তালেব তার বিখ্যাত বই "দ্য ব্ল্যাক সোয়ান" বইটিতে এই রূপকটি ব্যবহার করেছেন আমাদের জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য।
ব্ল্যাক সোয়ান কী?
একটি "ব্ল্যাক সোয়ান" ঘটনা তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের অধিকারী:
১. অস্বাভাবিকতা: এটি এমন একটি ঘটনা যা সাধারণ প্রত্যাশার বাইরে। অতীতের কোনো অভিজ্ঞতাই এমন ঘটনা ঘটার ইঙ্গিত দেয় না।
২. চরম প্রভাব: যখন এটি ঘটে, তখন এর প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী ও ধ্বংসাত্মক, অথবা অত্যন্ত ইতিবাচক।
৩. ভবিষ্যৎবাণীর বিভ্রম: ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর মানুষ নানারকম ব্যাখ্যা তৈরি করে দাবি করে যে এটি আসলে আগেই বোঝা সম্ভব ছিল। কিন্তু বাস্তবে, এটি ঘটার আগে কেউ তা আন্দাজ করতে পারেনি।
উদাহরণস্বরূপ, ৯/১১ এর হামলা, ইন্টারনেটের উত্থান বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধস, এগুলো সবই ব্ল্যাক সোয়ান ঘটনা।
আমাদের জগত: মিডিওক্রিস্তান বনাম এক্সট্রিমিস্তান
তালেব পৃথিবীকে দুটি কাল্পনিক রাজ্যে ভাগ করেছেন:
মিডিওক্রিস্তান
এটি হলো সাধারণ ও স্বাভাবিকতার জগত। এখানে ঘটনাগুলো গাণিতিক 'বেল কার্ভ' মেনে চলে। যেমন মানুষের উচ্চতা বা ওজন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী মানুষটিকে যদি ১০০০ জন সাধারণ মানুষের দলে যোগ করা হয়, তবে গড় ওজনে খুব একটা পরিবর্তন হবে না। এখানে ভবিষ্যৎবাণী করা কিছুটা সহজ।
এক্সট্রিমিস্তান
এটি হলো চরম অনিশ্চয়তার জগত। এখানে একটি মাত্র ঘটনা পুরো চিত্র বদলে দিতে পারে। যেমন সম্পদ, বইয়ের বিক্রি বা শেয়ার বাজার। যদি বিল গেটসকে ১০০০ জন সাধারণ মানুষের দলে যোগ করা হয়, তবে তিনি একাই ৯৯% সম্পদের মালিক হতে পারেন। ব্ল্যাক সোয়ান ঘটনাগুলো এই এক্সট্রিমিস্তানেই ঘটে।
টার্কি প্রবলেম: অতীতের তথ্যের বিপদ
অতীতের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎবাণী করার বিপদ বোঝাতে তালেব একটি মুরগির (বা টার্কির) উদাহরণ দিয়েছেন। ধরা যাক, একটি খামারি প্রতিদিন একটি টার্কিকে খাওয়াচ্ছে। ১০০০ দিন ধরে এই ঘটনা চলছে। টার্কিটি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে খামারি তাকে ভালোবাসে এবং তার জীবন নিরাপদ। ১০০০তম দিনে টার্কির আত্মবিশ্বাস থাকে তুঙ্গে। কিন্তু ১০০১তম দিনটি ছিল থ্যাঙ্কসগিভিং। সেদিন খামারি তাকে আদর করার বদলে জবাই করল। টার্কির জন্য এটি ছিল একটি ব্ল্যাক সোয়ান ঘটনা, কিন্তু কসাইয়ের জন্য নয়।
এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে,
প্রমাণের অনুপস্থিতি মানেই অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়।
আমরা কেন ভুল করি?
গল্প তৈরির প্রবণতা: আমরা জটিল ঘটনাগুলোকে সহজ গল্পে রূপান্তর করতে পছন্দ করি। কোনো বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর আমরা তার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি যে এটি অনিবার্য ছিল। এই প্রবণতা আমাদের ভবিষ্যতের ঝুঁকি সম্পর্কে অসতর্ক করে তোলে।
লুডিক ফ্যালাসি: আমরা বাস্তব জীবনের অনিশ্চয়তাকে খেলার (যেমন ক্যাসিনো) সুনির্দিষ্ট ঝুঁকির সাথে গুলিয়ে ফেলি। ক্যাসিনোতে নিয়ম ও সম্ভাবনা জানা থাকে, কিন্তু বাস্তব জীবনে নিয়ম যেকোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে।
আমাদের করণীয় কী?
ব্ল্যাক সোয়ান ঘটনাগুলোকে আগে থেকে অনুমান করা অসম্ভব। তাই তালেবের পরামর্শ হলো অনুমান করার চেষ্টা না করে প্রস্তুত থাকা।
বারবেল স্ট্র্যাটেজি
আপনার সম্পদের বা জীবনের সিংহভাগ (৮৫-৯০%) অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করুন, যাতে নেতিবাচক ব্ল্যাক সোয়ান আপনাকে ধ্বংস করতে না পারে। বাকি সামান্য অংশ (১০-১৫%) অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করুন, যাতে ইতিবাচক ব্ল্যাক সোয়ান থেকে লাভবান হতে পারেন। মাঝখানের মাঝারি ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন।
উপসংহার
আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যা আমাদের জানার চেয়েও অনেক বেশি জটিল ও অনিশ্চিত। ব্ল্যাক সোয়ান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা যা জানি না, তা আমাদের জানা তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অপ্রত্যাশিতের জন্য প্রস্তুত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
