আমাদের ব্রেইনের ওপর মিউজিকের গভীর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট ও হিলিং পাওয়ার

Healing power of music on the brain

আমরা যখন আমাদের প্রিয় গানটি শুনি, তখন ঠিক কী ঘটে? হয়তো আমাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, পায়ের পাতা অজান্তেই ছন্দে তাল মেলায়, অথবা কোনো গভীর স্মৃতি মনে পড়ে চোখ ভিজে যায়। আমরা অনেকেই সঙ্গীতকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখি। কিন্তু আধুনিক নিউরোসাইন্স এবং সাইকোলজি বলছে মিউজিক কেবল শব্দতরঙ্গ নয়; এটি একটি শক্তিশালী নিউরোকেমিক্যাল ককটেল, যা আমাদের মস্তিষ্ক, শরীর এবং আবেগের গঠনকে আমূল পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে।

আজকের এই লেখায় আমরা আলোচনা করব সঙ্গীতের সেই গভীর বৈজ্ঞানিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে, যা আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে জাদুর মতো কাজ করে।

১. মস্তিষ্কের জন্য 'হোল ব্রেইন ওয়ার্কআউট' 

আপনি যদি শরীরের পেশি গঠন করতে চান, তবে জিমে যান। আর যদি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে চান, তবে সঙ্গীতের আশ্রয় নিন। এফএমআরআই স্ক্যানে দেখা গেছে, সঙ্গীত শোনার সময় বা চর্চা করার সময় মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় প্রতিটি অংশ একসাথে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সঙ্গীত আমাদের মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধ (যুক্তি ও গণিত) এবং ডান গোলার্ধের (সৃজনশীলতা) মধ্যে সংযোগকারী সেতুকে শক্তিশালী করে। এর ফলে মস্তিষ্কের দুই অংশের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান দ্রুত হয়, যা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।

সঙ্গীত মস্তিষ্কের নতুন নিউরাল পাথওয়ে বা স্নায়বিক পথ তৈরি করতে সাহায্য করে। স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের পুনরুদ্ধারে মিউজিক থেরাপি এজন্যই এত কার্যকর।

২. নিউরোকেমিস্ট্রি: হরমোনের খেলা

সঙ্গীত সরাসরি আমাদের নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রের সাথে কথা বলে। এটি মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক নির্গত করে যা আমাদের মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে:

যখন আপনি আপনার পছন্দের গানটি শোনেন এবং গানের ক্লাইম্যাক্সে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তখন মূলত আপনার মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এটি সেই একই কেমিক্যাল যা সুস্বাদু খাবার খেলে বা কোনো বড় অর্জনের পর নির্গত হয়।

ধীর লয়ের গান (বিশেষ করে ৬০ বিট প্রতি মিনিট বা তার কম) শরীরে কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এটি রক্তচাপ ও হার্ট রেট কমায় এবং শরীরকে 'ফাইট অর ফ্লাইট' মোড থেকে 'রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট' মোডে নিয়ে আসে।

কনসার্টে সবার সাথে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া বা দলগত সঙ্গীতে অংশ নিলে মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন নির্গত হয়। এটি মানুষের মধ্যে বিশ্বাস এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে সাহায্য করে।

৩. আবেগের নিয়ন্ত্রণ এবং 'আইসো-প্রিন্সিপাল'

মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসায় বা মিউজিক থেরাপিতে একটি চমৎকার টেকনিক ব্যবহার করা হয়, যার নাম 'আইসো-প্রিন্সিপাল'।

আমরা প্রায়ই ভুল করি, মন খারাপ থাকলে জোর করে খুব আনন্দের গান শোনার চেষ্টা করি। এতে মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়। আইসো-প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, আপনার বর্তমান মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গান প্রথমে শোনা উচিত। অর্থাৎ, দুঃখের সময় বিষাদগ্রস্ত গান শুনলে মনে হয়, "কেউ একজন আমার কষ্টটা বুঝতে পারছে"। একে বলা হয় ভ্যালিডেশন। এরপর ধীরে ধীরে গানের মেজাজ পরিবর্তন করে আনন্দদায়ক গানে নিয়ে যেতে হয়। এটি আবেগের ক্যাথারসিস বা নিরাপদ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।

৪. স্মৃতিশক্তি এবং হিপ্পোক্যাম্পাস

কখনো কি এমন হয়েছে, ছোটবেলার কোনো গান শুনে হঠাৎ সেই সময়ের কোনো স্মৃতি ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে?

এর কারণ হলো, সঙ্গীত আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতি ও আবেগের কেন্দ্র 'হিপ্পোক্যাম্পাস' এবং 'অ্যামিগডালা' এর সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা পরিবারের সদস্যদের নাম ভুলে গেলেও তাদের যৌবনের প্রিয় গানটি ঠিকই মনে রাখতে পারেন এবং গাইতে পারেন। সঙ্গীত মস্তিষ্কের সেই বন্ধ দরজাগুলো খুলতে পারে, যা সাধারণ কথাবার্তা পারে না।

৫. মনোযোগ বৃদ্ধি এবং 'আলফা ওয়েভ'

কাজের সময় বা পড়াশোনার সময় সঠিক সঙ্গীত ফোকাস কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এখানে গানের ধরন গুরুত্বপূর্ণ।

লিরিক্স বা কথা ছাড়া মিউজিক (যেমন: ক্লাসিক্যাল, জ্যাজ বা লো-ফাই বিটস) মস্তিষ্কের 'আলফা ওয়েভ' সক্রিয় করতে সাহায্য করে। এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে আমরা শান্ত থাকি কিন্তু সতর্ক থাকি।

বাইনরাল বিটস এক ধরণের অডিও ইলিউশন যা মস্তিষ্কের তরঙ্গকে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে টিউন করতে পারে। পড়ার জন্য গামা ওয়েভ এবং ঘুমের জন্য ডেল্টা ওয়েভ অত্যন্ত কার্যকরী।

৬. শারীরিক সমন্বয় এবং এনট্রেনমেন্ট

প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ ছন্দের প্রতি দুর্বল। আমাদের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি সঙ্গীতের তালের সাথে তাল মেলাতে চায়, একে বলা হয় 'এনট্রেনমেন্ট'। এজন্যই জিম বা শরীরচর্চার সময় ফাস্ট-বিট মিউজিক আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। গান আমাদের মস্তিষ্ককে ক্লান্তির সংকেত উপেক্ষা করতে সাহায্য করে এবং এনডোরফিন (প্রাকৃতিক পেইনকিলার) নিঃসরণ বাড়ায়। ফলে আমরা দীর্ঘক্ষণ ব্যায়াম করতে পারি।

শেষ কথা 

সঙ্গীত কেবল অবসর সময়ের সঙ্গী নয়, এটি নিজেকে ভালো রাখার একটি শক্তিশালী টুলবক্স, সঙ্গীত হলো একটি লাইফস্টাইল। আধুনিক জীবনের মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং একাকীত্ব মোকাবিলায় সঙ্গীত হতে পারে আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই পরের বার যখন হেডফোন কানে লাগাবেন, মনে রাখবেন আপনি কেবল গান শুনছেন না, আপনি আপনার মস্তিষ্ককে নতুন করে সাজাচ্ছেন, আপনার আত্মাকে প্রশান্তি দিচ্ছেন এবং নিজেকে মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url