বিজ্ঞানের অচেনা জগত

mysteries of Science

বিজ্ঞান যত এগিয়েছে, আমরা তত গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি যে আমরা আসলে কত কম জানি। নিউটনের আপেল পড়া থেকে শুরু করে চাঁদে মানুষের পা রাখা, ডিএনএ এর গঠন আবিষ্কার থেকে শুরু করে ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা, প্রতিটি বড় আবিষ্কারই আমাদের সামনে আরও গভীর, আরও মৌলিক কিছু প্রশ্ন এনে দাঁড় করিয়েছে।

আজকের এই লেখায়, আমরা বিজ্ঞানের সেই সবচাইতে বড় অমীমাংসিত রহস্যগুলো নিয়ে কথা বলব, যা আজও বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। এই রহস্যগুলোর সমাধান শুধু আমাদের বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেবে না, বরং এর মধ্যে অনেকগুলোই সমাধান করার স্বীকৃতিস্বরূপ এনে দিতে পারে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান, নোবেল পুরস্কার।

চলুন ডুব দেওয়া যাক অজানার এই মহাসমুদ্রে।

প্রথম পর্ব: মহাবিশ্বের মহাবিভ্রান্তি

আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে যা দেখি, তা হলো এর মোট পদার্থের মাত্র ৫ শতাংশ! বাকি ৯৫ শতাংশই আমাদের কাছে অদৃশ্য এবং রহস্যময়।

১. ডার্ক ম্যাটার

আমরা জানি গ্যালাক্সিগুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরছে। কিন্তু তাদের দৃশ্যমান নক্ষত্র বা গ্যাসের মোট মহাকর্ষ বল দিয়ে এই গতিকে ব্যাখ্যা করা যায় না; গ্যালাক্সিগুলোর ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিশ্চয়ই এমন কোনো "অদৃশ্য পদার্থ" বা ডার্ক ম্যাটার আছে, যা অতিরিক্ত মহাকর্ষ বল জুগিয়ে গ্যালাক্সিগুলোকে একসাথে ধরে রেখেছে। মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% জুড়েই রয়েছে এই ডার্ক ম্যাটার।

রহস্য: এটি কী দিয়ে তৈরি? এটি কেন আলোর সাথে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না? একে ল্যাবরেটরিতে ধরার সব চেষ্টা এখনও ব্যর্থ হয়েছে।

২. ডার্ক এনার্জি 

ডার্ক ম্যাটারের চেয়েও বড় রহস্য হলো ডার্ক এনার্জি (মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮%)। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং এর প্রসারণের গতি সময়ের সাথে সাথে আরও বাড়ছে (Accelerating)। এর পেছনের কারণ হিসেবে এই ডার্ক এনার্জিকে দায়ী করা হয়, যা মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

রহস্য: এই শক্তির উৎস কী? এটি কি শূন্যস্থানের কোনো ধর্ম, নাকি নতুন কোনো মৌলিক বল? এর উত্তর আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির কথা বলে দেবে।

৩. সময়ের তীর 

কেন সময় কেবল এক দিকেই (অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে) প্রবাহিত হয়? পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব সূত্রই সময়ের দিক থেকে প্রতিসম (Time-symmetric), অর্থাৎ সূত্রগুলো সামনে বা পেছনে একইভাবে কাজ করার কথা। কিন্তু আমরা কখনও ভাঙা কাঁচকে নিজে থেকে জোড়া লেগে যেতে দেখি না।

রহস্য: ধারণা করা হয়, এটি এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলার সাথে সম্পর্কিত (মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা সব সময় বাড়ে)। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন মহাবিশ্ব শুরুতেই এত সুশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল?

৪. পদার্থের আধিপত্য 

বিগ ব্যাং এর সময় প্রতিটি কণার (Matter) সাথে সমান সংখ্যক প্রতি-কণা (Antimatter) তৈরি হওয়ার কথা ছিল। যদি তাই হতো, তবে তারা একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলত এবং মহাবিশ্বে শুধু শক্তিই অবশিষ্ট থাকত; কোনো গ্রহ, নক্ষত্র বা মানুষের অস্তিত্ব থাকত না।

রহস্য: কিন্তু আমরা দেখছি, মহাবিশ্ব পুরোটাই পদার্থ দিয়ে তৈরি। সেই প্রতি-পদার্থগুলো কোথায় গেল? কেন শুরুতেই পদার্থের পরিমাণ সামান্য হলেও বেশি ছিল?

দ্বিতীয় পর্ব: জীবন ও বাস্তবতার গভীরতম প্রশ্ন

রহস্য শুধু মহাকাশেই নয়, আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব এবং বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়েও রয়েছে গভীরতম প্রশ্ন।

৫. প্রাণের প্রথম স্পন্দন

আমরা জানি বিবর্তনের মাধ্যমে কীভাবে সরল প্রাণ থেকে জটিল প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রথম প্রাণটিই কীভাবে তৈরি হলো?

রহস্য: কীভাবে জড় রাসায়নিক পদার্থ (যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড, নিউক্লিওটাইড) একত্রিত হয়ে প্রথম স্ব-প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম (Self-replicating) সজীব কোষের উদ্ভব ঘটল? এই প্রক্রিয়াটি (Abiogenesis) এখনও বিজ্ঞানের অন্যতম বড় ধাঁধা।

৬. চেতনার রহস্য

এটি সম্ভবত বিজ্ঞানের সবচেয়ে গভীর প্রশ্ন। আমাদের মস্তিষ্ক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন স্নায়বিক সংযোগের একটি জটিল জৈব কম্পিউটার। কিন্তু কীভাবে এই ভৌত (Physical) অঙ্গটি আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, চিন্তা এবং 'আমি' (Self-awareness) নামক এই বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে?

রহস্য: মস্তিষ্ক থেকে কীভাবে 'মন' বা চেতনার জন্ম হয়, তার কোনো স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনও নেই।

৭. কোয়ান্টাম পরিমাপের সমস্যা 

কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী, কোনো কণা (যেমন ইলেকট্রন) পর্যবেক্ষণ করার আগে পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকে না। এটি একই সাথে একাধিক সম্ভাব্য অবস্থায় (Superposition) থাকতে পারে। কিন্তু যখনই আমরা সেটিকে পরিমাপ করতে যাই, এটি তৎক্ষণাৎ যেকোনো একটি নির্দিষ্ট অবস্থা বেছে নেয়।

রহস্য: "পর্যবেক্ষণ" এর কাজটি ঠিক কীভাবে এই সম্ভাব্য জগত থেকে বাস্তব জগতকে নির্বাচন করে? বাস্তবতা কি আমরা না তাকালে অস্পষ্ট থাকে?

৮. আমরা কেন ঘুমাই? 

আমরা জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটাই। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা (প্রাণী তখন অরক্ষিত থাকে)। তাই ঘুমের নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ আছে যা জেগে থাকা অবস্থায় করা সম্ভব নয়।

রহস্য: আমরা জানি ঘুম স্মৃতি গোছাতে এবং শরীর মেরামত করতে সাহায্য করে, কিন্তু ঠিক কোন মৌলিক জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের প্রতিদিন চেতনা হারাতে হয়, তার সুনির্দিষ্ট উত্তর এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

৯. ফার্মি প্যারাডক্স: সবাই কোথায়?

আমাদের গ্যালাক্সিতেই বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ রয়েছে, যার অনেকগুলোতেই প্রাণের উদ্ভব হতে পারে। যদি অন্য কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণী থাকত, তবে তাদের সভ্যতা আমাদের চেয়ে লক্ষ লক্ষ বছর এগিয়ে থাকার কথা এবং তাদের প্রযুক্তিগত উপস্থিতির চিহ্ন এতদিনে আমাদের পাওয়ার কথা ছিল।

রহস্য: তা সত্ত্বেও, আমরা এখনও ভিনগ্রহের প্রাণের বা তাদের পাঠানো কোনো সংকেতের বিন্দুমাত্র প্রমাণ পাইনি। সবাই কোথায়?

তৃতীয় পর্ব: ভবিষ্যতের নোবেল 

উপরের এই মৌলিক রহস্যগুলোর সমাধান নিঃসন্দেহে নোবেল পুরস্কারের দাবিদার। এর পাশাপাশি আরও কিছু নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য রয়েছে, যা অর্জন করতে পারলে তা মানব সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দেবে এবং গবেষকদের জন্য নোবেল জয় নিশ্চিত করবে।

১. থিওরি অফ এভরিথিং 

বিজ্ঞানের দুটি প্রধান স্তম্ভ সাধারণ আপেক্ষিকতা (মহাকর্ষ ও বৃহৎ বস্তু) এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স (ক্ষুদ্র কণা ও বল) পরস্পরের সাথে ঠিক খাপ খায় না। ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে বা বিগ ব্যাং এর মুহূর্তে এই দুই তত্ত্ব অকার্যকর হয়ে পড়ে।

নোবেল সম্ভাবনা: যে বিজ্ঞানী এমন একটি একক "কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি" তত্ত্ব বা 'থিওরি অফ এভরিথিং' প্রদান করতে পারবেন, যা এই দুই তত্ত্বকে একত্রিত করে মহাবিশ্বের সকল বলকে ব্যাখ্যা করতে পারে, তিনি হবেন একবিংশ শতাব্দীর আইনস্টাইন।

২. আলঝেইমারের নিরাময়

বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আলঝেইমার (Alzheimer's) বা পারকিনসন্সের মতো মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা এখনও জানি না কেন এই রোগগুলো হয় বা কীভাবে একে পুরোপুরি থামানো যায়।

নোবেল সম্ভাবনা: যে গবেষক এই রোগগুলোর মূল আণবিক কারণ উদঘাটন করে একটি কার্যকরী চিকিৎসা বা নিরাময় আবিষ্কার করবেন, তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে স্বস্তি এনে দেওয়ার জন্য নোবেল পেতে পারেন।

৩. বার্ধক্যের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ

বার্ধক্য কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা আমাদের সকল রোগের প্রতি দুর্বল করে তোলে। বিজ্ঞানীরা বার্ধক্যের মূল কারণ (যেমন: ডিএনএ-এর ত্রুটি, টেলোমিয়ার ছোট হয়ে যাওয়া) নিয়ে গবেষণা করছেন।

নোবেল সম্ভাবনা: বার্ধক্যের গতি কমানো বা আংশিকভাবে একে বিপরীত করার (Age Reversal) একটি কার্যকরী থেরাপি আবিষ্কার মানব স্বাস্থ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব হবে।

৪. রুম-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর

সুপারকন্ডাক্টর হলো এমন পদার্থ যা কোনো বাধা ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে, অর্থাৎ এতে কোনো শক্তি অপচয় হয় না। সমস্যা হলো, বর্তমানে এটি শুধু চরম ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় কাজ করে।

নোবেল সম্ভাবনা: যদি কোনো বিজ্ঞানী সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় ও চাপে কাজ করে এমন সুপারকন্ডাক্টর আবিষ্কার করতে পারেন, তবে বিদ্যুৎ সঞ্চালন, কম্পিউটার এবং পরিবহন ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন আসবে।

৫. জলবায়ু সমাধান: ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার

জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) শোষণ করে ফেলা।

নোবেল সম্ভাবনা: এমন একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকরী রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, যা দিয়ে বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বনকে শিল্প-কারখানার মতোই শুষে নিয়ে তাকে ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি বা নিরীহ পদার্থে রূপান্তর করা যাবে।

শেষ কথা

বিজ্ঞান কোনো গন্তব্য নয়, এটি একটি অন্তহীন যাত্রা। ডার্ক ম্যাটার থেকে শুরু করে চেতনার রহস্য পর্যন্ত—এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোই বিজ্ঞানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কে জানে, হয়তো এই লেখাটি পড়ার সময়ই কোনো ল্যাবরেটরিতে ভবিষ্যতের কোনো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী এই রহস্যগুলোর একটির দ্বার উন্মোচন করে ফেলছেন!

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url