৪৮টি ইন্টারেস্টিং হিউম্যান সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টস

Interesting Human Psychological Facts

আমরা প্রতিদিন নিজেদের এবং চারপাশের মানুষদের দেখি, কিন্তু আমরা কি সত্যিই বুঝি আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে? মানুষের মনস্তত্ত্ব বা সাইকোলজি এমন একটি আকর্ষণীয় বিষয়, যা আমাদের দৈনন্দিন আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ-অনুভূতির পেছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

কখনো ভেবে দেখেছেন কেন আমরা কোনো কোনো বিষয়ে অদ্ভুতভাবে একগুঁয়ে থাকি, অথবা কেন ভিড়ের মধ্যে বিপদে পড়া মানুষকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না? চলুন, মানব মনের এমন ৪৮টি ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক, যা আপনাকে নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।

১. ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট 

এটি মনোবিজ্ঞানের অন্যতম বিখ্যাত একটি তত্ত্ব। সহজ ভাষায়: যারা কোনো বিষয়ে কম জানেন, তারা প্রায়শই নিজেদের দক্ষতাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেন। তারা নিজেদের অজ্ঞতা সম্পর্কেই অজ্ঞ থাকেন। অন্যদিকে, যারা কোনো বিষয়ে সত্যিই জ্ঞানী বা দক্ষ, তারা প্রায়ই নিজেদের ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেন এবং ভাবেন যে কাজটি সবার কাছেই হয়তো সহজ।

২. কনফার্মেশন বায়াস

এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি সাধারণ প্রবণতা। আমরা সেই সব তথ্য বা প্রমাণ খুঁজি, বিশ্বাস করি এবং মনে রাখি যা আমাদের আগে থেকেই থাকা বিশ্বাস বা ধারণাকে সমর্থন করে। একই সাথে, আমরা সেই তথ্যগুলোকে এড়িয়ে চলি যা আমাদের ধারণার বিপরীত। একারণে নিজের বিশ্বাস বা মতামত পরিবর্তন করা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

৩. বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট 

যখন কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বা বিপদে অনেক লোক উপস্থিত থাকে, তখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাহায্য করার সম্ভাবনা উল্টো কমে যায়। এর কারণ হলো দায়িত্বের বিভাজন। প্রত্যেকে ভাবে, "হয়তো অন্য কেউ সাহায্য করবে" বা "যেহেতু কেউ কিছু করছে না, তার মানে হয়তো বিপদটা গুরুতর নয়।"

৪. স্পটলাইট ইফেক্ট

আমরা প্রায়ই ভাবি যে অন্যরা আমাদের চেহারা, পোশাক বা ছোটখাটো ভুলের দিকে যতটা মনোযোগ দিচ্ছে, আসলে তারা ততটা দেয় না। আমরা অবচেতনভাবে নিজেদেরকে একটা "স্পটলাইটের" নিচে কল্পনা করি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

৫. অ্যাঙ্করিং বায়াস

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা প্রথম যে তথ্যটি পাই (যাকে "অ্যাঙ্কর" বা নোঙর বলা হয়), তার ওপর খুব বেশি নির্ভর করি। পরবর্তী সব আলোচনা বা সিদ্ধান্ত এই প্রথম তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই হয়। যেমন: একটি পণ্যের দাম প্রথমে "৫০০০ টাকা" লিখে কেটে "৩০০০ টাকা" লেখা হলে আমরা ভাবি এটি খুব ভালো ছাড়, কারণ আমাদের মন ৫০০০ টাকার 'অ্যাঙ্করে' আটকে গেছে।

৬. পছন্দের প্যারাডক্স

আমরা মনে করি, যত বেশি অপশন থাকবে, আমাদের সিদ্ধান্ত তত ভালো হবে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে খুব বেশি অপশন থাকলে তা মানুষকে সিদ্ধান্তহীনতা, উদ্বেগ এবং সিদ্ধান্তের প্রতি কম সন্তুষ্টির দিকে ঠেলে দেয়। কম বিকল্প থাকলে মানুষ প্রায়শই বেশি সন্তুষ্ট থাকে।

৭. কগনিটিভ ডিসোনান্স

এটি এমন একটি মানসিক অস্বস্তি যখন একজন ব্যক্তির দুটি বিশ্বাস পরস্পরবিরোধী হয়, অথবা যখন তার বিশ্বাস এবং আচরণ একরকম হয় না। যেমন: একজন ব্যক্তি জানেন যে ধূমপান ক্ষতিকর (বিশ্বাস), কিন্তু তিনি ধূমপান করেন (আচরণ)। এই মানসিক অস্বস্তি কমানোর জন্য তিনি হয়তো বলবেন, "ধূমপান করলেই যে ক্যান্সার হবে এমন কোনো কথা নেই।"

৮. হ্যালো ইফেক্ট

এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে আমরা কোনো মানুষের একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য দেখে তার বাকি সব বৈশিষ্ট্যও ভালো বলে ধরে নিই। যেমন, একজন দেখতে সুন্দর মানুষকে আমরা অবচেতনভাবেই বুদ্ধিমান বা সৎ ভেবে বসি, যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই।

৯. জাইগারনিক ইফেক্ট 

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মস্তিষ্ক অসম্পূর্ণ কাজ বা বাধাগ্রস্ত কাজগুলোকে, সম্পন্ন হওয়া কাজের চেয়ে বেশি মনে রাখে। টিভি সিরিয়ালগুলো প্রায়ই একটি উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে পর্ব শেষ করে (ক্লিফহ্যাংগার), যাতে দর্শকরা পরের পর্ব দেখার জন্য আগ্রহী থাকেন। এটা এই ইফেক্টের কারণেই কাজ করে।

১০. ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর

যখন আমরা অন্যদের আচরণ বিচার করি, তখন আমরা তাদের ব্যক্তিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিই এবং পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করি। যেমনঃ অন্য কেউ পরীক্ষায় খারাপ করলে আমরা ভাবি, "সে অলস।" কিন্তু আমরা নিজেরা খারাপ করলে বলি, "প্রশ্ন খুব কঠিন ছিল"।

১১. দ্য মিরর-ইমেজ ইফেক্ট

আমরা সেই সমস্ত জিনিস বা মানুষদের বেশি পছন্দ করতে শুরু করি যা বা যাদের আমরা বারবার দেখি বা শুনি। শুধু পরিচিত হওয়ার কারণেই কোনো কিছুর প্রতি আমাদের ভালো লাগা তৈরি হতে পারে। এই কারণেই বিজ্ঞাপন বারবার দেখানো হয়।

১২. সাঙ্ক কস্ট ফ্যালাসি

যখন আমরা কোনো কিছুতে অর্থ, সময় বা শ্রম বিনিয়োগ করে ফেলি, তখন সেটি চালিয়ে যেতে চাই, এমনকি যদি তা আর লাভজনক নাও হয়। কারণ আমরা ভাবি, "যেহেতু এতকিছু করেই ফেলেছি, এখন ছেড়ে দিলে সব নষ্ট হবে।" এটি একটি অবাস্তব যুক্তি।

১৩. পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট

এর মূল কথা হলো, অন্যদের প্রতি আমাদের উচ্চাশা বা বিশ্বাস তাদের কর্মক্ষমতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একজন শিক্ষক যখন বিশ্বাস করেন কোনো ছাত্র ভালো করবে, তখন তার উৎসাহে ছাত্রটি সত্যিই ভালো করতে শুরু করে।

১৪. প্ল্যাসিবো ইফেক্ট

এটি মনোবিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী আবিষ্কারগুলোর একটি। যখন একজন ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তিনি একটি কার্যকরী চিকিৎসা নিচ্ছেন (যদিও তাকে হয়তো শুধু চিনির পিল দেওয়া হয়েছে), তখন তার অবস্থার উন্নতি হতে পারে। এটি দেখায় যে আমাদের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা আমাদের শরীরকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে।

১৫. অ্যাভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিক 

এটি একটি মানসিক শর্টকাট। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমাদের মনে যে উদাহরণ বা তথ্য সবচেয়ে সহজে বা সম্প্রতি আসে, আমরা তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিই। যেমন: প্লেন ক্র্যাশের খবর টিভিতে বেশি দেখা যায় বলে অনেকে প্লেনে চড়তে ভয় পান, যদিও পরিসংখ্যানগতভাবে গাড়ি দুর্ঘটনা অনেক বেশি সাধারণ।

১৬. পারষ্পরিকতার নীতি

এটি একটি অঘোষিত সামাজিক নিয়ম। যদি কেউ আমাদের জন্য ভালো কিছু করে (যেমন উপহার দেয়), আমরা মানসিকভাবে তার প্রতিদান দেওয়ার জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতা অনুভব করি। দোকানে 'ফ্রি স্যাম্পল' দেওয়ার এটি একটি বড় কারণ।

১৭. সিরিয়াল পজিশন ইফেক্ট 

এটি আমাদের স্মৃতিশক্তি নিয়ে একটি মজার পর্যবেক্ষণ। যখন আমাদের একটি তালিকা মনে রাখতে বলা হয় (যেমন, বাজারের তালিকা), তখন আমাদের তালিকার প্রথম দিকের জিনিসগুলো এবং শেষের দিকের জিনিসগুলো সবচেয়ে ভালো মনে থাকে। মাঝখানের জিনিসগুলো আমরা প্রায়ই ভুলে যাই।

১৮. মিসইনফরমেশন ইফেক্ট 

মানুষের স্মৃতি মোটেও ভিডিও রেকর্ডারের মতো নিখুঁত নয়। কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যদি আমরা সেই ঘটনা সম্পর্কে কোনো ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য পাই (যেমন, অন্য কারো মুখে ভুল বর্ণনা শুনি), তবে সেই ভুল তথ্যটি আমাদের আসল স্মৃতির সাথে মিশে যেতে পারে। পরে আমরা ওই ভুল তথ্যটিকেই আসল ঘটনা হিসেবে মনে করতে শুরু করি।

১৯. দ্য ডোর-ইন-দ্য-ফেস টেকনিক 

এটি কাউকে রাজি করানোর একটি কৌশল। প্রথমে, আপনি একটি অনেক বড় এবং অবাস্তব অনুরোধ করবেন, যা আপনি জানেন যে প্রত্যাখ্যাত হবে (যেমন, "আমাকে ৫,০০০ টাকা ধার দিতে পারবে?")। যখন ব্যক্তি "না" বলবে, তখন আপনি আপনার আসল এবং তুলনামূলকভাবে ছোট অনুরোধটি করবেন (যেমন, "আচ্ছা, ৫০০ টাকা হবে?")। প্রথম অনুরোধটি প্রত্যাখ্যান করার পর, দ্বিতীয় ছোট অনুরোধটি রক্ষা করার জন্য ব্যক্তি এক ধরণের সামাজিক চাপ অনুভব করে এবং রাজি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

২০. দ্য ফুট-ইন-দ্য-ডোর টেকনিক 

এটি উপরেরটির ঠিক বিপরীত। এখানে, আপনি প্রথমে একটি খুব ছোট এবং সহজ অনুরোধ করেন, যা মানতে কেউ সাধারণত আপত্তি করে না। যেমন, "আপনি কি এই পিটিশনটি স্বাক্ষর করবেন?"। যখন সেই ব্যক্তি রাজি হয়, তখন আপনি একটি সম্পর্কিত কিন্তু তুলনামূলকভাবে বড় অনুরোধ করেন। যেমন, "আপনি কি আমাদের প্রচারণার জন্য কিছু অর্থ দান করবেন?"। প্রথম ছোট অনুরোধে রাজি হওয়ার ফলে, ব্যক্তি নিজেকে "সহযোগী" বা "ভালো মানুষ" হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দ্বিতীয় অনুরোধেও রাজি হয়ে যেতে পারে।

২১. অপটিমিজম বায়াস

এটি এমন একটি মানসিক প্রবণতা যেখানে আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের নিজেদের জীবনে খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় কম এবং ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি। যেমন, অনেকেই মনে করেন যে "গাড়ি দুর্ঘটনা অন্যদের হতে পারে, আমার হবে না" অথবা "আমি অন্যদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচব।"

২২. নেগেটিভিটি বায়াস 

আমাদের মস্তিষ্ক ইতিবাচক তথ্যের চেয়ে নেতিবাচক তথ্যের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয় এবং সেগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়। একটি খারাপ অভিজ্ঞতা বা একটি নেতিবাচক মন্তব্য আমাদের মনে যতটা গভীর ছাপ ফেলে, ঠিক ততটাই ভালো দশটি অভিজ্ঞতাও হয়তো তা পারে না। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিপদ এড়িয়ে চলাই বেঁচে থাকার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

২৩. বারনাম ইফেক্ট 

এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে মানুষ খুব সাধারণ এবং অস্পষ্ট বর্ণনাকে (যেমন, রাশিফল বা কিছু পার্সোনালিটি টেস্ট) নিজের ব্যক্তিত্বের "অবিশ্বাস্যভাবে সঠিক" বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ এই বর্ণনাগুলো এতটাই সাধারণ হয় যে তা প্রায় সবার ক্ষেত্রেই কমবেশি খেটে যায়। যেমন: "আপনি মাঝে মাঝে নিজের ওপর আস্থা পান না, কিন্তু আপনার মধ্যে অনেক সুপ্ত প্রতিভা আছে"।

২৪. সোশ্যাল লোফিং 

যখন একদল লোক একসাথে কোনো কাজ করে, যেখানে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স আলাদাভাবে মাপা হয় না, তখন দলের সদস্যরা একা কাজ করার চেয়ে কম পরিশ্রম করে। দায়িত্ব ভাগ হয়ে যাওয়ায়, প্রত্যেকেই ভাবে যে অন্যেরা হয়তো তার কমতিটা পুষিয়ে দেবে।

২৫. ওভারজাস্টিফিকেশন ইফেক্ট 

যদি কোনো কাজ আমরা এমনিতেই করতে ভালোবাসি, যেমন ছবি আঁকা বা গিটার বাজানো, এবং সেই কাজের জন্য যদি আমাদের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়, যেমন: টাকা, তবে ধীরে ধীরে আমরা সেই কাজের প্রতি ভেতরের আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একসময় পুরস্কার না পেলে আমরা আর সেই কাজটি করতে চাই না।

২৬. ইমোশনাল রিজনিং

এটি একটি চিন্তার ত্রুটি যেখানে আমরা নিজের অনুভূতিকে বাস্তবতার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করি। অর্থাৎ, "আমার যেহেতু এমনটা মনে হচ্ছে, তার মানে এটাই সত্যি।" যেমন: "আমি খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছি, তার মানে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে" (যদিও খারাপ কিছু ঘটার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই)। অথবা "আমার নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে, তার মানে আমি সত্যিই একজন ব্যর্থ মানুষ।"

২৭. সেলফ-সার্ভিং বায়াস

এটি আমাদের নিজেদের আত্মসম্মান রক্ষা করার একটি কৌশল। আমরা যখন কোনো কাজে সফল হই, তখন আমরা এর কৃতিত্ব নিজের দক্ষতাকে দিই। কিন্তু যখন আমরা ব্যর্থ হই, তখন আমরা বাইরের পরিস্থিতিকে দায়ী করি।

২৮. হাইন্ডসাইট বায়াস

কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমাদের মনে হয় যে, "আমি তো জানতাম এমনটাই ঘটবে"। অর্থাৎ, কোনো ঘটনার ফলাফল জেনে ফেলার পর সেই ঘটনাটিকে আমাদের কাছে অনেক বেশি অনুমানযোগ্য মনে হয়, যদিও ঘটনাটি ঘটার আগে তা মোটেও ততটা স্পষ্ট ছিল না।

২৯. জাস্ট-ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস

এটি এমন একটি বিশ্বাস যে "পৃথিবী একটি ন্যায়পরায়ণ জায়গা" এবং মানুষ যা পায় তা তার প্রাপ্য। অর্থাৎ, ভালো মানুষের সাথে ভালো হয়, আর খারাপ মানুষের সাথে খারাপ হয়। এই বিশ্বাসটি অনেক সময় বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এর ফলে মানুষ ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করতে শুরু করে। যেমন: "তার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে, কারণ সে নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছে।"

৩০. রিভার্স সাইকোলজি

যখন একজন ব্যক্তি অনুভব করে যে তার কোনো স্বাধীনতা বা পছন্দকে খর্ব করা হচ্ছে বা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তখন সে তীব্রভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রায়শই সে ঠিক উল্টো কাজটি করে বসে, যা তাকে করতে বারণ করা হয়েছিল। রিভার্স সাইকোলজি একটি ম্যানিপুলেটিভ কৌশল এবং এটি সব সময় কাজ করে না। এটি সাধারণত জেদি, বিদ্রোহী বা খুব স্বাধীনচেতা মানুষের ওপর বেশি কার্যকর।

৩১. গ্রুপথিঙ্ক 

যখন একটি দল এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে দলের সম্প্রীতি বা ঐক্য বজায় রাখাটা সঠিক বা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে, দলের সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করতে ভয় পান বা সমালোচনামূলক চিন্তা এড়িয়ে চলেন, যা প্রায়শই বিপর্যয়কর সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়।

৩২. ডিইন্ডিভিজুয়েশন

এটি এমন একটি অবস্থা যখন একজন ব্যক্তি কোনো ভিড় বা দলের অংশ হয়ে নিজের ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আত্ম-সচেতনতা হারিয়ে ফেলে। যখন মানুষ মনে করে যে ভিড়ের মধ্যে তাকে চেনা যাচ্ছে না, তখন তার দায়িত্ববোধ কমে যায় এবং সে এমন আচরণ করে বসে যা সে একা থাকলে কখনোই করত না। যেমনঃ দাঙ্গা বা সাইবার বুলিং।

৩৩. চয়েস-সাপোর্টিভ বায়াস 

আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যেমন: একটি নতুন ফোন কিনি, তখন আমরা আমাদের পছন্দকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য সেটির শুধু ভালো দিকগুলোই মনে রাখি এবং যে বিকল্পগুলো আমরা ত্যাগ করেছি সেগুলোর খারাপ দিকগুলো বেশি করে মনে করি।

৩৪. ফ্রিকোয়েন্সি ইলিউশন

এটি এমন একটি অভিজ্ঞতা যখন আপনি নতুন কোনো শব্দ, ধারণা বা জিনিসের সাথে পরিচিত হন এবং হঠাৎ করেই খেয়াল করেন যে সেটি "সব জায়গায়" দেখা যাচ্ছে। আসলে জিনিসটি হয়তো আগে থেকেই ছিল, কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক এখন সেটির প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল হয়ে ওঠায় তা আপনার চোখে বেশি পড়ছে।

৩৫. আইকিয়া ইফেক্ট

আমরা সেই সমস্ত জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত মূল্য বা ভালোবাসা অনুভব করি যা আমরা নিজেরা আংশিকভাবে তৈরি করেছি। যে জিনিসটি তৈরি করতে আমরা নিজে শ্রম বা কষ্ট করেছি, সেটি আমাদের কাছে নিখুঁতভাবে তৈরি জিনিসের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে হয়।

৩৬. ক্লাস্টারিং ইলিউশন

এটি হলো সম্পূর্ণ র‍্যান্ডম বা এলোমেলো ঘটনার মধ্যে একটি প্যাটার্ন বা গুচ্ছ খুঁজে বের করার প্রবণতা। আমাদের মস্তিষ্ক বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে না, তাই সে সবকিছুর মধ্যেই একটি অর্থপূর্ণ বিন্যাস খোঁজার চেষ্টা করে। 

৩৭. লস অ্যাভারশন

কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দের চেয়ে তা হারানোর কষ্ট আমাদের কাছে অনেক বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ, ১০০ টাকা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, ১০০ টাকা হারিয়ে ফেলার কষ্টের চেয়ে অনেক কম। একারণে মানুষ ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চায়, পাছে কিছু হারাতে না হয়।

৩৮. ফ্রেমিং ইফেক্ট

একই তথ্যকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের সিদ্ধান্ত নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে। যেমন: একটি সার্জারির ব্যাপারে যদি বলা হয়, "এতে ৯০% রোগী বেঁচে যায়", তবে মানুষ বেশি আগ্রহী হবে। কিন্তু যদি বলা হয়, "এতে ১০% রোগী মারা যায়", তবে মানুষ ভয় পাবে, যদিও দুটি তথ্যই একই।

৩৯. এন্ডাওমেন্ট ইফেক্ট

যখন আমরা কোনো জিনিসের মালিক হয়ে যাই, তখন সেই জিনিসটির মূল্য আমাদের কাছে অবাস্তবভাবে বেড়ে যায়। আমরা যে দামে জিনিসটি কিনতে রাজি ছিলাম, মালিক হওয়ার পর তার চেয়ে অনেক বেশি দামে সেটি বিক্রি করতে চাই।

৪০. পিক-এন্ড রুল 

যখন আমরা কোনো অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করি, যেমন: ছুটি কাটানো বা কোনো অনুষ্ঠান, তখন আমরা পুরো অভিজ্ঞতার গড় বিচার করি না। আমাদের স্মৃতি দুটি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়: সেই অভিজ্ঞতার সবচেয়ে তীব্র মুহূর্তটি এবং শেষ মুহূর্তটি।

৪১. হেডোনিক অ্যাডাপটেশন

মানুষ খুব দ্রুত ভালো বা খারাপ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং তাদের সুখ বা সন্তুষ্টির একটি নির্দিষ্ট বেসলাইন বা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। যেমন: লটারি জেতার মতো খুব খুশির ঘটনা বা দুর্ঘটনার মতো খুব দুঃখের ঘটনা, উভয় ক্ষেত্রেই, কিছু সময় পর মানুষ তার আগের মানসিক অবস্থায় ফিরে আসে।

৪২. বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ইফেক্ট

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একবার বলেছিলেন, "যে আপনার একবার উপকার করেছে, সে আবার উপকার করতে ততটা দ্বিধা বোধ করবে না, যতটা আপনি যার উপকার করেছেন সে করবে।" মনোবিজ্ঞান বলে, যখন আমরা কারও কোনো উপকার করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক সেই কাজটিকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য ধরে নেয় যে, "আমি নিশ্চয়ই লোকটিকে পছন্দ করি, তাই তার উপকার করেছি।" এর ফলে, সেই ব্যক্তির প্রতি আমাদের ইতিবাচক মনোভাব আরও বেড়ে যায়। অর্থাৎ, শত্রুকে বন্ধু বানানোর একটি উপায় হতে পারে তার কাছে ছোট কোনো সাহায্য চাওয়া।

৪৩. সেলফ-হ্যান্ডিক্যাপিং 

এটি আত্মসম্মান রক্ষার একটি কৌশল। যখন একজন ব্যক্তি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যর্থ হওয়ার ভয় পায়, তখন সে ইচ্ছে করেই নিজের পথে বাধা তৈরি করে। যেমনঃ পরীক্ষার আগে সারারাত না ঘুমিয়ে থাকা। কারণ: যদি সে ব্যর্থ হয়, তবে সে বলতে পারবে, "আমি তো প্রস্তুতির সময় পাইনি", এতে ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী করতে হবে না। আর যদি সে সফল হয়, তবে সে ভাববে, "প্রস্তুতি ছাড়াই আমি পেরেছি, তার মানে আমি সত্যিই খুব মেধাবী।"

৪৪. সোশ্যাল ডিসায়ারেবিলিটি বায়াস 

এটি সাধারণত জরিপ বা সাক্ষাৎকারে দেখা যায়। মানুষ প্রায়শই এমন উত্তর দেয় যা সামাজিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য বা "সঠিক" বলে বিবেচিত, যদিও তা তাদের প্রকৃত মতামত বা আচরণের থেকে ভিন্ন হতে পারে। তারা চায় অন্যরা যেন তাদের ভালো বা নৈতিক বলে মনে করে।

৪৫. ইন-গ্রুপ ফেভারিটিজম

এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে আমরা নিজের দলের সদস্যদেরকে অন্য দলের সদস্যদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই, তাদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল হই এবং তাদের ভালো মনে করি, এমনকি যদি এই দলগুলো সম্পূর্ণ এলোমেলোভাবে তৈরি করা হয়।

৪৬. দ্য লুডিক ফ্যালাসি 

এটি হলো বাস্তব জীবনকে গেম বা পরিসংখ্যানের মডেলের মতো সহজ ভাবার প্রবণতা। আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে বাস্তব জীবন লটারি বা তাসের খেলার মতো নিয়ন্ত্রিত নিয়মের মধ্যে চলে না। বাস্তব জীবনে অপ্রত্যাশিত ঘটনা, জটিল মানবিক আবেগ এবং অসংখ্য অজানা চলক থাকে, যা গাণিতিক মডেলে ধরা যায় না।

৪৭. প্রোজেকশন বায়াস

এটি এমন একটি প্রবণতা যেখানে আমরা অবচেতনভাবে ধরে নিই যে অন্যরাও আমাদের মতোই চিন্তা করে, অনুভব করে এবং বিশ্বাস করে। আমরা আমাদের নিজেদের মানসিক অবস্থাকে অন্যের ওপর "প্রোজেক্ট" বা আরোপ করি।

৪৮. এমপ্যাথি গ্যাপ 

আমরা প্রায়শই বুঝতে ব্যর্থ হই যে আমাদের মানসিক বা শারীরিক অবস্থা আমাদের আচরণ ও সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে। যেমন: যখন পেট ভরা থাকে, তখন আমরা বুঝতে পারি না যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমরা কতটা খিটখিটে আচরণ করতে পারি। অথবা শান্ত অবস্থায় আমরা ভাবি যে রেগে গেলে আমরা মাথা ঠান্ডা রাখব, কিন্তু বাস্তবে তা পারি না।

৪৯. ক্র্যাব মেন্টালিটি 

একটি বালতিতে যদি অনেক কাঁকড়া থাকে, তবে কোনো একটি কাঁকড়া যখন বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করে, তখন অন্য কাঁকড়ারা তাকে টেনে নিচে নামিয়ে ফেলে। এটি মানুষের আচরণেও দেখা যায়, যখন কোনো দলের মধ্যে কেউ একজন উন্নতি করতে চাইলে বাকিরা তাকে টেনে ধরে বা ঈর্ষান্বিত হয়ে তার অগ্রগতিতে বাধা দেয়।

৫০. দ্য ট্রুম্যান শো ডিলিউশন 

এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তার জীবন একটি সাজানো রিয়েলিটি টিভি শো এবং তাকে সবাই পর্যবেক্ষণ করছে।

শেষ কথা

মানুষের মন সত্যিই এক জটিল গোলকধাঁধা। এই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবগুলো প্রতিদিন আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পর্ক এবং পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গিকে প্রভাবিত করছে, অথচ আমরা হয়তো তা টেরও পাচ্ছি না। নিজের মনের এই অজানা দিকগুলো জানা আমাদের আরও পরিণত ও যুক্তিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং আমাদের আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে, নিজেদের ও অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url