জীবনের অর্থহীনতা এবং বেঁচে থাকার শিল্প: আলবেয়ার কামুর দর্শন

Meaninglessness of Life

আমরা কেন বাঁচি? প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, ফিরে আসা, খাওয়া এবং আবার ঘুমিয়ে পড়া, এই অন্তহীন চক্রের আসল উদ্দেশ্য কী?

কখনো না কখনো, জীবনের কোনো এক নিস্তব্ধ মুহূর্তে, এই প্রশ্নগুলো আমাদের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দেয়। আমরা আকাশের দিকে তাকাই, উত্তরের আশায়। আমরা ধর্মের কাছে যাই, দর্শনের কাছে যাই, শুধু একটি নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য যে—আমাদের এই বেঁচে থাকার একটা মহৎ কোনো কারণ আছে।

কিন্তু যদি কোনো কারণ না থাকে? যদি এই বিশাল মহাবিশ্ব আমাদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে?

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক আলবেয়ার কামু ঠিক এই নিষ্ঠুর সত্যটির মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়েছেন। তার দর্শন আমাদের প্রচলিত আশার বেলুন ফুটো করে দেয়, কিন্তু একই সাথে আমাদের শেখায় কীভাবে ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়েও মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়।

অ্যাবসার্ডিজম: অসংগতির মুখোমুখি

কামুর দর্শনের মূল ভিত্তি হলো 'অ্যাবসার্ড' বা অসংগতির ধারণা। মানুষ জন্মগতভাবে যুক্তিবাদী; সে প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ এবং জীবনের একটি স্পষ্ট অর্থ খুঁজতে চায়। কিন্তু সমস্যা হলো, যে পৃথিবীতে সে বাস করে, তা অযৌক্তিক এবং নীরব।

মানুষের এই অর্থের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং মহাবিশ্বের এই নীরব উদাসীনতা, এই দুইয়ের সংঘর্ষই হলো 'অ্যাবসার্ড'।

কামু তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস' এ একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন:

"সত্যি বলতে কেবল একটিই গুরুতর দার্শনিক সমস্যা আছে, আর তা হলো আত্মহত্যা। জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য কি না, এই বিচার করাই হলো দর্শনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।"

যদি জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ না থাকে, তবে কি বেঁচে থাকাটা অর্থহীন নয়? তাহলে কি আত্মহত্যাই একমাত্র যৌক্তিক পথ?

কামু জোরালোভাবে বলেন—'না'।

পলায়ন নয়, বিদ্রোহ

কামুর মতে, জীবনের অর্থহীনতাকে আবিষ্কার করার পর মানুষ সাধারণত দুটি ভুল পথের একটি বেছে নেয়:

১. শারীরিক আত্মহত্যা: শারীরিক আত্মহত্যা হলো জীবনের অসংগতি বা অর্থহীনতার কাছে চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করা। এটি সমস্যার সমাধান নয়, বরং অস্তিত্বকে মুছে ফেলার মাধ্যমে সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া। জীবনের নিরর্থকতা সহ্য করতে না পেরে এই আত্মসমর্পণ সাহসিকতা নয়, বরং দুর্বলতা।

২. দার্শনিক আত্মহত্যা: এটি হলো মিথ্যে আশার আশ্রয় নেওয়া। এমন কোনো পরকাল বা ঈশ্বর বা ভবিষ্যতের ইউটোপিয়াতে বিশ্বাস করা, যা এই জীবনের সব কষ্টের কাল্পনিক অর্থ প্রদান করে। কামুর মতে, এটি নিজেকে ধোঁকা দেওয়া। এটি বর্তমানের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ভবিষ্যতের কোনো কাল্পনিক সুখের জন্য বেঁচে থাকা।

কামু আমাদের তৃতীয় একটি পথ দেখান। সেটি হলো—বিদ্রোহ।

The only way to deal with an unfree world is to become so absolutely free that your very existence is an act of rebellion.

বিদ্রোহ মানে কোনো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ নয়। বিদ্রোহ মানে হলো জীবনের এই অর্থহীনতাকে সম্পূর্ণ সচেতনভাবে মেনে নেওয়া এবং তারপরেও বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া। মহাবিশ্ব আমাকে কোনো অর্থ দিচ্ছে না জেনেও, আমি আমার নিজের শর্তে বাঁচব, এটাই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ।

সিসিফাস: আমাদের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি

গ্রিক পুরাণে সিসিফাসের শাস্তি ছিল একটি বিশাল পাথর ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তোলা। কিন্তু চূড়ায় পৌঁছানো মাত্রই পাথরটি আবার নিচে গড়িয়ে পড়ত। এবং সিসিফাসকে অনন্তকাল ধরে এই অর্থহীন পরিশ্রম পুনরাবৃত্তি করতে হতো।

আমাদের জীবন কি সিসিফাসের মতো নয়? আমরাও প্রতিদিন আমাদের নিজস্ব 'পাথর' ঠেলে ওপরে তুলি (আমাদের কাজ, সংগ্রাম, রুটিন), শুধু পরের দিন আবার শূন্য থেকে শুরু করার জন্য।

কিন্তু কামু এখানেই এক অসাধারণ মোড় নিলেন। তিনি বললেন, যখন সিসিফাস পাথরটি গড়িয়ে পড়ার পর আবার নিচে নেমে আসে পাথরটি তোলার জন্য, সেই মুহূর্তটিই গুরুত্বপূর্ণ। ওটাই তার 'সচেতনতার মুহূর্ত'। সে জানে তার কষ্টের কোনো শেষ নেই, কোনো মহৎ প্রাপ্তি নেই। তবু সে আবার পাথরটি ঠেলতে শুরু করে।

এই যে জেনে বুঝে নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়া এবং হার না মানা, এখানেই সিসিফাস দেবতাদের চেয়েও মহান হয়ে ওঠেন। তার এই নিরর্থক প্রচেষ্টাই তার বিদ্রোহ।

কামু তার প্রবন্ধের শেষে এক অবিস্মরণীয় উক্তি করেছেন:

The struggle itself towards the heights is enough to fill a man's heart. One must imagine Sisyphus happy.

বেঁচে থাকার শিল্প

যদি জীবনের কোনো মহৎ অর্থ না থাকে, তবে কি জীবন মূল্যহীন? একদমই না। কামুর দর্শন হতাশার নয়, বরং মুক্তির।

যখন আপনি মেনে নেবেন যে কোনো ভবিষ্যতের আশা বা স্বর্গ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে না, তখনই আপনি সত্যিকারের স্বাধীন। আপনি তখন আর ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানকে বলিদান করবেন না।

বেঁচে থাকার পথটি হলো: 

বর্তমান মুহূর্তে তীব্রভাবে বেঁচে থাকা।

কামুর উপন্যাস 'দ্য স্ট্রেঞ্জার' এর নায়ক মেউর্সোল্টের মতো, আমাদের জীবনের ছোট ছোট সংবেদনশীল অভিজ্ঞতাগুলোকে আলিঙ্গন করতে হবে। সূর্যের উষ্ণতা, সমুদ্রের নোনা হাওয়া, প্রিয়জনের স্পর্শ, এক কাপ কফির স্বাদ, এগুলোই জীবনের আসল সত্য। কোনো বিমূর্ত ধারণার চেয়ে এই শারীরিক অস্তিত্ব অনেক বেশি বাস্তব।

জীবনের অর্থ খোঁজা বন্ধ করুন, বরং জীবনকে 'অনুভব' করা শুরু করুন।

শেষ কথা

জীবনের অর্থহীনতা কোনো অভিশাপ নয়, এটি একটি সাদা ক্যানভাস। যেহেতু কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ নেই, তাই আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে, আমাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে, আমাদের ভালোবাসার মাধ্যমে সেই ক্যানভাসে নিজেদের অর্থ তৈরি করতে পারি। আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব পাথর ঠেলছি। আমরা জানি একদিন মৃত্যু আসবে এবং সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যতক্ষণ আমরা শ্বাস নিচ্ছি, ততক্ষণ এই অর্থহীনতার মুখের ওপর দাঁড়িয়ে হেসে যাওয়া এবং পাথরটি ঠেলে যাওয়ার মধ্যেই মানুষের সত্যিকারের মর্যাদা নিহিত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url