প্রিজনার্স অফ জিওগ্রাফি: দ্য পাওয়ার & দ্য ফিউচার

Prisoners of Geography: The Power & The Future

আমরা যখন বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, বা বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উত্থান-পতন নিয়ে চিন্তা করি, তখন সাধারণত নেতা, মতাদর্শ, অর্থনীতি বা প্রযুক্তির কথা ভাবি। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ টিম মার্শাল তার বইয়ের মাধ্যমে আমাদের একটি মৌলিক সত্য মনে করিয়ে দিয়েছেন: সবকিছুর মূলেই রয়েছে ভূগোল।

একটি দেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র, মরুভূমি এবং জলবায়ু, এইসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে দেয় সেই দেশের ইতিহাস, বর্তমানের সিদ্ধান্ত এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। নেতারা যতই শক্তিশালী হোন না কেন, দিনশেষে তারা তাদের ভূগোলের হাতে "বন্দী"।

টিম মার্শালের বিখ্যাত "জিওগ্রাফি" ট্রিলজি "প্রিজনার্স অফ জিওগ্রাফি", "দ্য পাওয়ার অফ জিওগ্রাফি", এবং "দ্য ফিউচার অফ জিওগ্রাফি", এই গভীর বিষয়টিকেই তিনটি ধাপে ব্যাখ্যা করে। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

🗺️ প্রিজনারস অফ জিওগ্রাফি

এই বইটি হলো মূল ভিত্তি। মার্শাল এখানে দেখিয়েছেন কিভাবে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর বিদেশনীতি এবং ঐতিহাসিক আচরণ তাদের ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। তিনি ১০টি মানচিত্রের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন।

মূল ধারণা: নেতারা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পাহাড় স্থায়ী। একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো তার ভৌগোলিক সুবিধা ও অসুবিধাগুলো।

কিছু প্রধান উদাহরণ:

রাশিয়া: রাশিয়ার ইতিহাস হলো একটি উষ্ণ-জলীয় বন্দর খোঁজার ইতিহাস। তাদের উত্তরের বন্দরগুলো শীতে বরফে জমে যায়। একারণেই ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দর তাদের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ, যা কৃষ্ণ সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথ দেয়। এছাড়া, রাশিয়ার পশ্চিম দিক পুরোটাই সমভূমি, কোনো প্রাকৃতিক বাধা (পাহাড়) নেই। একারণে রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবেই তার পশ্চিমে একটি "বাফার জোন" তৈরি করতে চেয়েছে, যা আমরা ইউক্রেন সংকটের মাধ্যমে আজও দেখছি।

চীন: চীন পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর দ্বারা সুরক্ষিত, দক্ষিণে হিমালয় পর্বতমালা, যা ভারতকে আলাদা করে রেখেছে, এবং পশ্চিমে মরুভূমি। কিন্তু চীনের প্রায় ৯০% মানুষ দেশের পূর্ব অর্ধাংশে বাস করে। তাদের বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়। তাই চীন এখন একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করছে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে, যেন তার বাণিজ্য পথগুলো নিরাপদ থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রকে ভৌগোলিকভাবে "আশীর্বাদপুষ্ট" বলা হয়। এর দু'পাশে দুটি বিশাল মহাসাগর, আটলান্টিক ও প্যাসিফিক, যা দেশটিকে আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখে। দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে মিসিসিপি নদীর মতো সুবিশাল নাব্য নদী ব্যবস্থা, যা কৃষিপণ্য ও মালামাল পরিবহনে বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং দেশকে একতাবদ্ধ করেছে।

আফ্রিকা: মার্শাল দেখিয়েছেন, আফ্রিকার অনুন্নয়নের পেছনে ঔপনিবেশিকতা বা দুর্নীতির পাশাপাশি ভূগোলও একটি বড় কারণ। আফ্রিকার নদীগুলো, যেমন কঙ্গো নদী, অসংখ্য জলপ্রপাতের কারণে নৌচলাচলের অযোগ্য। এর উপকূল রেখা অত্যন্ত মসৃণ, যার ফলে প্রাকৃতিক গভীর সমুদ্রবন্দরের সংখ্যা খুবই কম। ফলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য, দুটোই কঠিন হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যে ঔপনিবেশিকদের আঁকা কৃত্রিম সীমানা সংঘাতের মূল কারণ। ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীরের পার্বত্য ভূগোল নিয়ে এক অনিবার্য দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। কোরিয়া তার ভূগোলের কারণে প্রতিবেশীদের 'দাবা'য় পরিণত হয়েছে, আর দ্বীপরাষ্ট্র হওয়ায় জাপান সামুদ্রিক শক্তি হয়ে উঠেছে। ল্যাটিন আমেরিকায় আন্দিজ ও আমাজন জঙ্গল উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সবশেষে, আর্কটিকের বরফ গলে নতুন নৌপথ ও সম্পদ উন্মুক্ত হওয়ায় এটি ভূ-রাজনীতির নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।

🌍 দ্য পাওয়ার অফ জিওগ্রাফি

প্রথম বইয়ের সাফল্যের পর, মার্শাল এই বইতে এমন ১০টি অঞ্চলের দিকে ফোকাস করেছেন যা হয়তো বর্তমানে বিশ্বশক্তি নয়, কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।

মূল ধারণা: ভূগোলের নিয়মগুলো এখনো বদলায়নি এবং এগুলোই নতুন নতুন সংঘাত ও শক্তির কেন্দ্র তৈরি করছে।

কিছু উদীয়মান অঞ্চল:

অস্ট্রেলিয়া, একটি মহাদেশসম রাষ্ট্র, পশ্চিমা মিত্র হওয়া সত্ত্বেও ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল, যা তার জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি। অন্যদিকে, ইরানের পার্বত্য "দুর্গ" ভূগোল তাকে প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও টিকে থাকতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করেছে। তেল ও বালির ওপর নির্ভরশীল সৌদি আরব এক ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সংকটের মুখে; তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

ব্রেক্সিটের পর দ্বীপরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে তার বৈশ্বিক ভূমিকা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হচ্ছে এবং নতুন বাণিজ্য ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। গ্রিস তার কৌশলগত সামুদ্রিক অবস্থানের কারণে ইউরোপের 'গেটওয়ে' এবং তুরস্কের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তুরস্ক হলো ইউরোপ ও এশিয়ার 'সেতুবন্ধন', যা গুরুত্বপূর্ণ বসফরাস প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চারপাশের সংঘাতে প্রভাব ফেলে।

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল তীব্র খরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীল সীমান্তের কারণে অস্থিতিশীলতা ও শরণার্থী সংকটের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। স্থলবেষ্টিত ইথিওপিয়া ব্লু নাইল নদের উৎসে বিশাল ড্যাম নির্মাণ করে ভাটির দেশ মিশর ও সুদানের ওপর ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করেছে। স্পেন ভূমধ্যসাগরের 'চোক পয়েন্ট' জিব্রাল্টার প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে এবং কাতালোনিয়ার মতো অভ্যন্তরীণ বিভাজনও তার নীতিকে প্রভাবিত করে।

🚀 দ্য ফিউচার অফ জিওগ্রাফি

এই সিরিজের সর্বশেষ বইটিতে মার্শাল একটি রোমাঞ্চকর প্রশ্ন তুলেছেন: পৃথিবীর ভূগোল যদি আমাদের বন্দী করে রাখে, তবে সেই বন্দীত্ব থেকে মুক্তির উপায় কী? উত্তর: মহাকাশ।

কিন্তু মার্শাল যুক্তি দেন, আমরা হয়তো পৃথিবী থেকে মুক্ত হচ্ছি, কিন্তু আমরা আমাদের পুরনো অভ্যাসগুলো সাথে নিয়েই যাচ্ছি। এই বইয়ের মূল বিষয় হলো "অ্যাস্ট্রোপলিটিক্স" বা মহাকাশ-রাজনীতি।

মূল ধারণা: মহাকাশ কোনো শূন্যস্থান নয়; এটি নিজেই একটি নতুন ভূগোল, যেখানে নতুন করে "উঁচু ভূমি", "বাণিজ্য পথ" এবং "সম্পদ" দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

ভবিষ্যতের ভূগোল:

ভূ-পৃষ্ঠের কক্ষপথ: লো আর্থ অরবিট (LEO) এবং জিওস্টেশনারি অরবিট (GEO) হলো ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক স্থান। যার স্যাটেলাইট এই কক্ষপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই জিপিএস (GPS), ইন্টারনেট, ব্যাংকিং এবং সামরিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করবে।

লাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট: মহাকাশে এমন কিছু বিশেষ পয়েন্ট আছে যেখানে দুটি বড় বস্তুর (যেমন পৃথিবী ও চাঁদ) মহাকর্ষ বল একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এই পয়েন্টগুলোতে স্যাটেলাইট বা স্পেস স্টেশন রাখলে নূন্যতম জ্বালানীতে কাজ করা যায়। এগুলো ভবিষ্যতের "সামরিক ঘাঁটি" বা "টোল প্লাজা" হয়ে উঠতে পারে।

চাঁদ ও মঙ্গল: চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বরফ (পানি) এবং হিলিয়াম-৩ (ভবিষ্যতের জ্বালানি) পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখন চাঁদে বেস (Base) গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এটি অনেকটা আন্টার্কটিকা দখলের মতো।

উপসংহার 

আমরা কি কখনো মুক্ত হতে পারবো? টিম মার্শালের এই তিনটি বই আমাদের একটি পরিষ্কার বার্তা দেয়: প্রযুক্তি যত উন্নত হোক না কেন, আমরা কখনোই আমাদের ভৌগোলিক বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবো না।

"প্রিজনার্স অফ জিওগ্রাফি" আমাদের শেখায় কেন পৃথিবী আজ এমন। "পাওয়ার অফ জিওগ্রাফি" আমাদের দেখায় ভবিষ্যতের সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুগুলো। সবশেষে, "দ্য ফিউচার অফ জিওগ্রাফি" সতর্ক করে যে, আমরা পৃথিবীর মাটির লড়াইকে এখন মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর কক্ষপথ, চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহই হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের সেই নতুন "ভূগোল", যা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ক্ষমতা।

বিশ্বকে বুঝতে হলে, প্রথমে আপনাকে মানচিত্রটি বুঝতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url