স্কিন ইন দ্য গেম
আমরা প্রায়ই টিভিতে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষজ্ঞদের বড় বড় কথা বলতে শুনি। অর্থনীতিবিদরা বলেন শেয়ার বাজার কোথায় যাবে, পলিটিশিয়ানরা বলেন যুদ্ধ করা উচিত কি না, আর কনসালট্যান্টরা বড় বড় কোম্পানিকে উপদেশ দেন কীভাবে ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য করেছেন কি? যদি তাদের ভবিষ্যৎবাণী ভুল হয় বা তাদের উপদেশে কোম্পানির ক্ষতি হয়, তবে তাদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হয় না।
সহজ কথায়:
"স্কিন ইন দ্য গেম" মানে হলো আপনি যদি কোনো সিদ্ধান্তের সুফল ভোগ করেন, তবে সেই সিদ্ধান্তের কারণে কোনো বিপর্যয় ঘটলে তার দায়ভার বা ক্ষতিও আপনাকে নিতে হবে।
আজকের এই লেখায় নাসিম নিকোলাস তালেবের 'স্কিন ইন দ্য গেম' বইটির মূল আইডিয়াগুলো সম্পর্কে আলোচনা করবোঃ
১. ঝুঁকি ও পুরস্কারের ভারসাম্য
পৃথিবী বর্তমানে এমন সব মানুষের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যারা সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক ফলাফলের দায় নেয় না।
উদাহরণ: একজন পাইলট যখন প্লেন চালান, তখন তার 'স্কিন ইন দ্য গেম' থাকে। কারণ প্লেন ক্র্যাশ করলে যাত্রীদের সাথে পাইলটও মারা যাবেন। তাই পাইলট কখনোই অযথা ঝুঁকি নেন না।
অন্যদিকে, একজন ব্যাংকার বা ফিনান্সিয়াল অ্যানালিস্ট যখন ভুল জায়গায় বিনিয়োগের পরামর্শ দেন এবং ধস নামে, তখন সাধারণ মানুষের টাকা যায়, কিন্তু সেই ব্যাংকার তার বোনাস ঠিকই পকেটে নিয়ে নেন। একে তালেব বলেছেন: নিজের ঝুঁকি অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া।
এমন কাউকে বিশ্বাস করবেন না, যে আপনাকে উপদেশ দেয় কিন্তু সেই উপদেশের ফলাফল ভোগ করে না।
২. হ্যামুরাবির আইন এবং প্রাচীন শিক্ষা
প্রায় ৪০০০ বছর আগে ব্যবিলনের রাজা হ্যামুরাবির আইনে বলা ছিল:
যদি কোনো স্থপতি একটি বাড়ি বানায় এবং সেই বাড়ি ধসে পড়ার কারণে বাড়ির মালিক মারা যায়, তবে সেই স্থপতিকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
এটি শুনতে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনের যুক্তি হলো: স্থপতি যখন জানবেন যে তার কাজের ভুলের মাশুল তাকেই দিতে হবে, তখন তিনি সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে বাড়িটি বানাবেন। আধুনিক সমাজে আমরা এই দায়বদ্ধতা হারিয়ে ফেলেছি।
৩. দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ইয়েট ইডিয়ট
বইটির অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত অংশ হলো 'বুদ্ধিজীবী কিন্তু আহাম্মক' ধারণাটি। তালেব আধুনিক বিশ্বের একশ্রেণীর মানুষকে কঠোর সমালোচনা করেছেন যারা আইভি লিগ বা বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী, কিন্তু বাস্তব জগত সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।
এরা কারা?
এরা সাধারণ মানুষকে বলে কী খেতে হবে, কাকে ভোট দিতে হবে এবং কীভাবে বাঁচতে হবে।
এরা জটিল থিওরি বোঝে কিন্তু নিজের গাড়ির টায়ার বদলাতে পারে না।
এরা নিজেদের ভুলের জন্য কখনো শাস্তি পায় না, বরং ভুল করলে তারা ব্যাখ্যা দেয় যে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
তালেবের মতে, একজন সাধারণ বয়স্ক লোকের জ্ঞান, যিনি ৭০ বছর বাস্তব অভিজ্ঞতায় বেঁচে আছেন, একজন ৩৫ বছর বয়সী পিএইচডি ডিগ্রিধারী পলিসি মেকারের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
৪. সংখ্যালঘুর আধিপত্য
গণতন্ত্রে আমরা মনে করি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই চূড়ান্ত। কিন্তু তালেব গণিতের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, আসলে সমাজ পরিবর্তন করে একগুঁয়ে বা নাছোড়বান্দা সংখ্যালঘুরা।
পুরো সমাজকে কোনো নিয়ম মানাতে ৫১% মানুষের দরকার হয় না, দরকার হয় মাত্র ৩-৪% মানুষের যারা আপোষ করতে রাজি নয়।
উদাহরণ: ধরুন একটি পার্টিতে ১০০ জন মানুষ আছে। এর মধ্যে মাত্র ৪ জন পিনাট বা বাদাম খেতে পারে না (এলার্জি আছে)। বাকি ৯৬ জন পিনাট খেতে পছন্দ করে। কিন্তু আয়োজক পুরো পার্টির মেনু থেকে পিনাট বাদ দিয়ে দেবেন। কারণ, যারা পিনাট খায় তাদের পিনাট না খেলে সমস্যা নেই, কিন্তু যাদের এলার্জি আছে তারা পিনাট থাকলে খাবেই না বা অসুস্থ হয়ে যাবে।
এভাবেই সমাজের নৈতিকতা, খাদ্যাভ্যাস এবং আইন পরিবর্তিত হয়, অধিকাংশের ইচ্ছায় নয়, বরং ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর অনমনীয়তার কারণে।
৫. গোল্ডেন রুল বনাম সিলভার রুল
আমরা ছোটবেলা থেকে 'গোল্ডেন রুল' বা সুবর্ণ নিয়ম শিখে এসেছি: অন্যের সাথে তেমন আচরণ করো, যেমনটা তুমি নিজের সাথে চাও। তালেব বলেন, এটি সবসময় সঠিক নয়। কারণ আমি যা চাই, আপনি তা নাও চাইতে পারেন।
এর বদলে তিনি 'সিলভার রুল' অনুসরণের পরামর্শ দেন:
অন্যের সাথে এমন আচরণ করো না, যা তুমি নিজের সাথে হতে দিতে চাও না।
এটি অনেক বেশি নিরাপদ এবং যৌক্তিক। এটি মানুষকে ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখে।
৬. অথেন্টিসিটি
আপনি কতটা সফল বা ধনী সেটা আসল বিষয় নয়। আসল বিষয় হলো আপনার স্বাধীনতা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা।
যিনি বসের কথায় উঠেন আর বসেন, তিনি যতই বেতন পান না কেন, তিনি আসলে ক্রীতদাস।
যিনি নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন এবং ভুলের মাশুল দিতে প্রস্তুত, তিনিই প্রকৃত স্বাধীন মানুষ।
শেষ কথা
পৃথিবীটা থিওরি বা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়ে চলে না। এটি চলে বাস্তব ঝুঁকি এবং সাহসের ওপর।
জীবনে যদি কাউকে বিশ্বাস করতে হয়, তবে দেখুন তার হারানোর কিছু আছে কি না। যদি দেখেন কেউ কেবল লাভের অংশীদার হতে চায় কিন্তু লোকসানের ভাগ নিতে চায় না, তবে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসুন। ঝুঁকিহীন সাফল্য আসলে এক ধরণের প্রতারণা।
