ডিপ ওয়ার্ক: বিক্ষিপ্ত পৃথিবীতে ফোকাস ধরে রাখার উপায়

How to Deep Work

বর্তমান যুগে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে মনোযোগ ধরে রাখা সবচাইতে কঠিন কাজ। ফেসবুকের নোটিফিকেশন, ইমেইলের টুংটাং শব্দ, আর রিলসের অসীম দুনিয়া, সবকিছুই যেন আমাদের মনোযোগ কাড়ার জন্য যুদ্ধ করছে। নিউপোর্ট তাঁর বেস্টসেলার বই "ডিপ ওয়ার্ক" এ দেখিয়েছেন, কীভাবে এই কোলাহলের মধ্যেও গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে জীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করা যায়।

আজকের এই লেখায় আমরা জানবো ডিপ ওয়ার্ক কী এবং কীভাবে এটি আপনার কর্মজীবনকে বদলে দিতে পারে।

১. ডিপ ওয়ার্ক আসলে কী?

ক্যাল নিউপোর্ট কাজকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন:

ডিপ ওয়ার্ক: এটি হলো এমন কাজ যা আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে, কোনো প্রকার বিভ্রান্তি বা ডিস্ট্রাকশন ছাড়া করেন। এই অবস্থায় আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। এই ধরনের কাজ নতুন কিছু সৃষ্টি করে এবং আপনার দক্ষতাকে শানিত করে।

শ্যালো ওয়ার্ক: কম মনোযোগ দিয়ে করা কাজ, যা সাধারণত লজিস্টিক্যাল বা প্রশাসনিক ধরনের হয়। যেমন: ইমেইলের উত্তর দেওয়া, ছোটখাটো মিটিং করা বা সোশ্যাল মিডিয়া চেক করা। এই কাজগুলো সহজেই অনুকরণ করা যায় এবং এগুলো নতুন কোনো ভ্যালু তৈরি করে না।

বর্তমান অর্থনীতিতে ডিপ ওয়ার্ক করার ক্ষমতা বিরল হয়ে উঠছে, অথচ এর মূল্য দিন দিন বাড়ছে। যারা এই দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারবে, ভবিষ্যৎ তাদেরই।

২. আপনার জন্য সঠিক রুটিন কোনটি?

সবার কাজের ধরন এক নয়। নিউপোর্ট ডিপ ওয়ার্ক করার জন্য ৪টি পদ্ধতির কথা বলেছেন:

  1. মোনাস্টিক: সন্ন্যাসীদের মতো সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজ করা। এটি লেখক বা গবেষকদের জন্য বেশি উপযোগী। 
  2. বাইমোডাল: সময়কে দুই ভাগে ভাগ করা। যেমন, সপ্তাহের ৪ দিন গভীর কাজ করবেন এবং বাকি ৩ দিন সাধারণ কাজ ও যোগাযোগ রাখবেন। 
  3. রিদমিক: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করা। যেমন: প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত কোনো ফোন বা ইন্টারনেট ছাড়া কাজ করা। এটি চাকরিজীবী এবং ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর। 
  4. জার্নালিস্টিক: দিনের যেকোনো ফাঁকা সময়ে (যেমন মিটিংয়ের মাঝে ২০ মিনিট) চট করে গভীর মনোযোগে ঢুকে যাওয়া। এটি বেশ কঠিন এবং অভিজ্ঞদের জন্য প্রযোজ্য।

৩. ডিপ ওয়ার্ক করার ৪টি নিয়ম 

বইটিতে লেখক চারটি মূল নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন:

নিয়ম ১: গভীরভাবে কাজ করুন। ইচ্ছাশক্তি অসীম নয়। তাই কাজের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করুন যেন মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়। একটি নির্দিষ্ট স্থান এবং সময় ঠিক করে নিন।

নিয়ম ২: একঘেয়েমিকে মেনে নিন। আমরা একটু বোর হলেই ফোন হাতে তুলে নিই। এতে আমাদের মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। গভীর মনোযোগের জন্য বোরিং বা একঘেয়ে সময় কাটানো শিখতে হবে। কাজের ফাঁকে বা জ্যামে বসে থাকার সময় ফোন না ঘেঁটে মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিন।

নিয়ম ৩: সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ রাখুন। সোশ্যাল মিডিয়া আপনার সময়ের সবচেয়ে বড় শত্রু। কোনো টুল ব্যবহার করার আগে ভাবুন "এটি কি আমার মূল লক্ষ্যের জন্য সত্যিই জরুরি?" যদি উত্তর 'না' হয়, তবে তা বর্জন করুন।

নিয়ম ৪: অগভীর কাজ কমান। অপ্রয়োজনীয় মিটিং, ইমেইল এবং চ্যাটিং কমিয়ে ফেলুন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় রাখুন (যেমন বিকাল ৪টা-৫টা) শুধু ইমেইল বা মেসেজের উত্তর দেওয়ার জন্য। বাকি সময়টা 'ডু নট ডিস্টার্ব' মোডে থাকুন।

৪. শাটডাউন রিচুয়াল 

দিনশেষে কাজের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা খুব জরুরি। নিউপোর্ট একটি চমৎকার কৌশলের কথা বলেছেন 'শাটডাউন রিচুয়াল'। কাজ শেষ করার আগে ৫ মিনিট সময় নিন: 

  1. আগামীকালের কাজের তালিকা তৈরি করুন। 
  2. আজকের অসম্পূর্ণ কাজগুলো নোট করুন। 
  3. নিজেকে মুখে বলুন, "শাটডাউন কমপ্লিট"। 

এরপর কাজ নিয়ে আর কোনো চিন্তা করবেন না। এটি আপনাকে পরদিন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে সাহায্য করবে।

শেষ কথা 

সফলতার সমীকরণটি খুব সহজ: 

উচ্চমানের কাজ = (সময়) x (মনোযোগের তীব্রতা) 

আপনি যদি কম সময়ে বেশি এবং ভালো মানের কাজ করতে চান, তবে ডিপ ওয়ার্ক হতে পারে আপনার জীবনের গেম চেঞ্জার।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url