জীবন বদলাতে দর্শন: নিজেকে চেনার আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও বাস্তব প্রয়োগ

Philosophy As A Way Of Life

দর্শন কি কেবল বইয়ের পাতার কঠিন তত্ত্ব? নাকি জীবন বদলানোর হাতিয়ার?

দর্শন বা ফিলোসফি শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে কী ভেসে ওঠে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ধুলোমাখা ক্লাসরুম, মোটা চশমা পরা কোনো অধ্যাপক, আর কিছু দুর্বোধ্য তাত্ত্বিক আলোচনা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়। তাই তো?

কিন্তু ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে হাদো আমাদের এই ধারণাটি পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর যুগান্তকারী বই 'Philosophy as a Way of Life' এ তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, প্রাচীনকালে দর্শন কেবল মস্তিষ্কের ব্যায়াম ছিল না, এটি ছিল 'আত্মার চিকিৎসা' এবং জীবন যাপনের একটি পদ্ধতি।

আজকের এই লেখায় আমরা সেই হারিয়ে যাওয়া দর্শনের গভীরে যাব, যেখানে সক্রেটিস থেকে ফুকো পর্যন্ত, দর্শন ছিল নিজেকে বদলে ফেলার এক নিরন্তর সাধনা।

১. দর্শন বনাম দর্শনের আলোচনা

'দর্শন' এবং 'দর্শন নিয়ে আলোচনা' এক জিনিস নয়।

আধুনিক যুগে আমরা যা করি, তা হলো 'দর্শন নিয়ে আলোচনা'। আমরা পড়ি কান্ট কী বলেছেন, হেগেল কী যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু প্রাচীন গ্রিস বা রোমে, একজন মানুষ নিজেকে 'দার্শনিক' দাবি করতে পারতেন না যদি না তিনি সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন।

স্টয়িকদের কাছে যুক্তিবিদ্যা বা লজিক কেবল পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না, বরং এটি ছিল মানসিক প্রশান্তির ঢাল। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, সঠিক যুক্তি দিয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জীবনের যেকোনো বিপর্যয়ে লজিক তাদের শেখাত কোনটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর কোনটি নয়, যা তাদের কঠিনতম সময়েও অবিচল ও শান্ত রাখতে সাহায্য করত।

এপিকিউরিয়ানদের কাছে সুখ মানে অঢেল ভোগবিলাস ছিল না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, অপ্রয়োজনীয় ও কৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করলেই প্রকৃত প্রশান্তি মেলে। রুটি আর জলের মতো সামান্য জিনিসে তুষ্ট থেকে তাঁরা কৃতজ্ঞচিত্তে বর্তমান মুহূর্তকে উপভোগ করতেন। তাঁদের দর্শন ছিল অহেতুক ভীতি ঝেড়ে ফেলে কেবল 'বেঁচে থাকার আনন্দে' অবগাহন করা।

মূলত দর্শন কোনো পুঁথিগত বিদ্যা নয়, এটি মূলত একটি 'Existential Choice' বা অস্তিত্বের নির্বাচন। অর্থাৎ, এটি এমন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যা গ্রহণ করলে মানুষের সত্তা ও জীবনযাপনের ভঙ্গি আমূল বদলে যায়। এটি কেবল বিশ্বজগতকে ব্যাখ্যা করে না, বরং নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে এক নতুন মানুষে রূপান্তর করে, যেখানে প্রতিটি কাজ সেই দর্শনেরই প্রতিফলন।

২. আধ্যাত্মিক অনুশীলন

বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো 'Spiritual Exercises' বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ধারণা। তবে এখানে 'আধ্যাত্মিক' বলতে হাদো কোনো ধর্মীয় আচার বোঝাচ্ছেন না। তিনি বোঝাচ্ছেন এমন কিছু মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চর্চা, যা আমাদের 'সত্তা' বা 'Being' কে পরিবর্তন করে।

প্রাচীন দার্শনিকরা প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট অনুশীলন করতেন। চলুন দেখে নিই এমন কয়েকটি শক্তিশালী অনুশীলন:

মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি: কল্পনা করুন, আপনি পৃথিবীকে অনেক ওপর থেকে দেখছেন। মহাকাশ থেকে দেখলে আমাদের বড় বড় সমস্যা, ঝগড়া, আর অহংকারকে কতটা ক্ষুদ্র মনে হবে! প্রাচীন দার্শনিকরা এই প্র্যাকটিসটি করতেন নিজেদের ক্ষুদ্রতা বুঝতে এবং অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে। এটি আমাদের শেখায় যে, মহাবিশ্বের বিশালতার তুলনায় আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো নিতান্তই তুচ্ছ।

মৃত্যুর ধ্যানে জীবনকে চেনা: সক্রেটিস বলতেন, দর্শন হলো মৃত্যুর প্রস্তুতি। শুনতে নেতিবাচক মনে হতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর কথা মনে রাখার মানে হলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে তীব্রভাবে ভালোবাসা। যখন আপনি জানবেন সময় সীমিত, তখন আপনি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। বর্তমান মুহূর্তটি তখন এক পরম উপহার হিসেবে ধরা দেয়।

বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ: স্টয়িক এবং এপিকিউরিয়ান প্রাচীন এই উভয় দার্শনিক স্কুলই আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভারী বোঝা, অর্থাৎ অতীতের অনুশোচনা এবং ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলার আহ্বান জানায়। দর্শন আমাদের শেখায় কীভাবে কাল্পনিক সময়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে কেবল বর্তমানে এই মুহুর্তটিতে বাঁচতে হয়। স্টয়িকদের কাছে বর্তমান মানে হলো ধ্রুব সতর্কতা; তারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের বিচারবুদ্ধি ও কাজকে নৈতিকভাবে পাহারা দেয় যাতে কোনো ভুল না হয়। অন্যদিকে, এপিকিউরিয়ানদের কাছে বর্তমান হলো কৃতজ্ঞচিত্তে অস্তিত্বকে উপভোগ করার নাম। তারা মনে করে, প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি অপ্রত্যাশিত উপহার, তাই ভবিষ্যতের আশায় বসে না থেকে এখনই জীবনের সরল আনন্দটুকু শুষে নেওয়া উচিত।

৩. সক্রেটিস: একজন জীবন্ত দার্শনিক

পিয়েরে হাদো সক্রেটিসকে দর্শনের প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। সক্রেটিস কোনো বই লেখেননি। তিনি বাজারে ঘুরে ঘুরে মানুষকে প্রশ্ন করতেন। তাঁর উদ্দেশ্য মানুষকে নতুন তথ্য শেখানো ছিল না, বরং মানুষকে বিব্র‍ত করা ছিল, যাতে তারা নিজেদের জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

সক্রেটিসের দর্শন ছিল তাঁর চরিত্র। তাঁর মৃত্যু, তাঁর শান্ত থাকা, এবং সত্যের প্রতি অবিচল থাকা, এটাই ছিল তাঁর ফিলোসফি। হাদো বলেন, সক্রেটিস আমাদের শেখান যে দর্শন কোনো 'থিওরি' নয়, এটি হলো নিজেকে চেনার এবং নিজের যত্ন নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া।

৪. আমরা কেন এই পথ হারালাম?

হাদো খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে দর্শন তার আসল রূপ হারালো। মধ্যযুগে যখন বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটি কালচার চালু হলো, দর্শন হয়ে গেল ধর্মতত্ত্বের দাস। দর্শন আর 'জীবন যাপনের উপায়' রইল না, এটি হয়ে গেল কেবল ক্লাসরুমে শেখানোর একটি বিষয়। আর আধুনিক যুগে এটি হয়ে গেছে কেবল প্রফেশনাল স্কলারদের গবেষণার বিষয়।

শেষ কথা: দর্শনে ফেরা

আপনি যখন কোনো ফিলোসফির বই পড়বেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন:

এই তথ্যটি কি কেবল আমার জ্ঞান বাড়াচ্ছে, নাকি এটি আমার জীবনকে উন্নত করছে? এটি কি আমাকে রাগ নিয়ন্ত্রণে, মৃত্যুভয় কাটাতে, বা বর্তমানকে উপভোগ করতে সাহায্য করছে?

দর্শন যদি আপনার দুঃখ কমাতে না পারে, যদি আপনাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে না পারে, তবে সেই দর্শনের কোনো মূল্য নেই। আসুন, আমরা দর্শনকে আবারও আমাদের নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে এবং দৈনন্দিন জীবনে ফিরিয়ে আনি।

Next Post
No Comment
Add Comment
comment url