পেল ব্লু ডট: মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর ছবি এবং কার্ল সেগানের সেই কালজয়ী বার্তা

Pale Blue Dot

আমরা প্রায়শই নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। আমাদের দৈনন্দিন সমস্যা, রাজনৈতিক বিভেদ, আর অহংকার আমাদের এতটাই গ্রাস করে রাখে যে আমরা ভুলে যাই এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান আসলে কতটা নগণ্য। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি চিরতরে বদলে দেয়। ১৯৯০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঠিক এমনই একটি দিন ছিল।

আজকের এই লেখায় আমরা কথা বলব একটি ছবি নিয়ে, যে ছবিতে আমাদের পুরো পৃথিবীটা দেখাচ্ছে মাত্র একটি ধূলিকণার মতো। এবং আমরা পড়ব সেই ছবির পেছনের কারিগর, প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের সেই অবিস্মরণীয় বার্তা, যা 'পেল ব্লু ডট' বা 'আবছা নীল বিন্দু' নামে পরিচিত।

একটি অসম্ভব ছবির গল্প

১৯৯০ সাল। নাসার মহাকাশযান 'ভয়েজার ১' তার মূল মিশন শেষ করে সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছিল। পৃথিবী থেকে তখন তার দূরত্ব প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার।

এই সময় কার্ল সেগান নাসার কাছে এক অদ্ভুত আবদার করে বসলেন। তিনি বললেন, 'ভয়েজার ১' এর ক্যামেরাটি শেষবারের মতো পৃথিবীর দিকে ঘোরানো হোক এবং আমাদের গ্রহের একটি ছবি তোলা হোক।

নাসার বিজ্ঞানীরা প্রথমে রাজি ছিলেন না। একে তো সূর্যের দিকে ক্যামেরা ঘোরানোয় লেন্স নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল, তার ওপর এত দূর থেকে তোলা ছবিতে পৃথিবীর কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। কিন্তু সেগান নাছোড়বান্দা ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, এই ছবিটির হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক মূল্য নেই, কিন্তু এর যে 'পারিপার্শ্বিক' বা দার্শনিক মূল্য রয়েছে, তা অপরিসীম।

অবশেষে ছবিটি তোলা হলো। এবং ফলাফল দেখে বিশ্ববাসী স্তব্ধ হয়ে গেল। বিশাল মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকারে, সূর্যের বিক্ষিপ্ত রশ্মির মাঝে ঝুলে থাকা একটি অতি ক্ষুদ্র, আবছা নীল রঙের বিন্দু। ওটাই আমাদের পৃথিবী।

পেল ব্লু ডট: সেগানের সেই কালজয়ী বার্তা

আবার তাকান সেই বিন্দুর দিকে। ওটাই আমাদের ঠিকানা। ওটাই আমাদের ঘর। ওটাই আমরা। ওখানেই আপনার ভালোবাসার প্রতিটি মানুষ, আপনার পরিচিত প্রতিটি মুখ, আপনি যাদের কথা শুনেছেন তাদের প্রত্যেকে, এবং ইতিহাসে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানুষ তাদের জীবন অতিবাহিত করেছে।

আমাদের সমস্ত আনন্দ ও বেদনার সমষ্টি, হাজারো আত্মবিশ্বাসী ধর্ম, মতবাদ ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব; প্রত্যেক শিকারি ও সংগ্রাহক, প্রত্যেক বীর ও কাপুরুষ, সভ্যতার প্রত্যেক নির্মাতা ও ধ্বংসকারী; প্রত্যেক রাজা ও প্রজা, প্রেমে মগ্ন প্রতিটি তরুণ দম্পতি, প্রত্যেক মা ও বাবা, আশাদীপ্ত শিশু, উদ্ভাবক ও অভিযাত্রী; নীতির প্রতিটি শিক্ষক, প্রত্যেক দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, প্রত্যেক 'সুপারস্টার', প্রত্যেক 'সর্বোচ্চ নেতা', এবং আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে আসা প্রতিটি সাধু ও পাপী, সবাই ওখানেই বসবাস করেছে, সূর্যের রশ্মিতে ঝুলে থাকা এক ধূলিকণা মাত্র।

এই বিশাল মহাজাগতিক অঙ্গনে পৃথিবী এক অতি ক্ষুদ্র মঞ্চ। ভাবুন সেই সব সেনাপতি ও সম্রাটদের কথা, যারা এক বিন্দুর সামান্য এক ভগ্নাংশের ক্ষণিকের মালিক হওয়ার গৌরবে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছে। ভাবুন এই ক্ষুদ্র বিন্দুর এক কোণে বসবাসকারীদের দ্বারা অন্য কোণের প্রায় একই রকম দেখতে বাসিন্দাদের ওপর চাপানো অন্তহীন নিষ্ঠুরতার কথা, তাদের ভুল বোঝাবুঝি কত ঘনঘন হয়, একে অপরকে হত্যা করতে তারা কতটা উদগ্রীব, তাদের ঘৃণা কতটা তীব্র।

আমাদের সমস্ত অহংকার, আমাদের কাল্পনিক আত্ম-গুরুত্ব, মহাবিশ্বে আমাদের এক বিশেষ স্থান রয়েছে এমন ভ্রম, সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ জানায় এই আবছা আলোকবিন্দুটি। আমাদের গ্রহটি এই বিশাল মহাজাগতিক অন্ধকারের মাঝে একাকী এক কণা মাত্র। আমাদের এই অস্পষ্টতায়, এই বিশাল শূন্যতার মাঝে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে অন্য কোথাও থেকে কেউ এসে আমাদের নিজেদের হাত থেকে আমাদেরই রক্ষা করবে।

এখন পর্যন্ত জানা একমাত্র পৃথিবীই হলো জীবনের ধারক। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে অন্য কোথাও আমাদের প্রজাতির স্থানান্তরিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভ্রমণ করা সম্ভব, কিন্তু বসতি স্থাপন এখনও নয়। পছন্দ হোক বা না হোক, এই মুহূর্তের জন্য পৃথিবীই আমাদের একমাত্র দাঁড়ানোর জায়গা।

বলা হয়ে থাকে যে জ্যোতির্বিজ্ঞান হলো এমন এক অভিজ্ঞতা যা মানুষকে বিনয়ী করে এবং চরিত্র গঠন করে। মানুষের অহংকারের মূর্খতা প্রমাণের জন্য দূর থেকে তোলা আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীর ছবির চেয়ে ভালো কোনো উদাহরণ হয়তো আর নেই। আমার কাছে, একে অপরের প্রতি আরও সদয় হওয়ার এবং এই 'আবছা নীল বিন্দু', আমাদের জানা একমাত্র ঘরটিকে, রক্ষা করার ও যত্ন নেওয়ার দায়িত্বের কথাই এটি মনে করিয়ে দেয়।

শেষ কথা 

কার্ল সেগানের এই কথাগুলো আজও আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়। এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা কিছুই নই। আমাদের সব দম্ভ, জাতিগত ভেদাভেদ, আর ক্ষমতার লড়াই মহাকাশের প্রেক্ষাপটে হাস্যকর।

৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে পৃথিবীতে কোনো দেশের সীমানা রেখা দেখা যায় না। সেখানে শুধু একটি গ্রহ, একটি প্রজাতি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই এক। এই মুহূর্ত পর্যন্ত, এই ছোট্ট নীল বিন্দুটিই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। একে ধ্বংস করলে আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তাই এই গ্রহকে রক্ষা করা আমাদের সবার যৌথ দায়িত্ব।

ভয়েজার ১ এখন সৌরজগতের বাইরে, আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া এই ছবিটি চিরকাল মানবজাতির জন্য একটি আয়না হয়ে থাকবে, যে আয়নায় আমরা আমাদের প্রকৃত অবস্থান দেখতে পাই।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url