নিউরোপ্লাস্টিসিটি: আপনার ব্রেইনকে যেকোনো বয়সে আপগ্রেড করুন
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আমাদের মনে হয় "এখন কি আর আমার শেখার বয়স আছে, এই বয়সে আর কোন কিছু শেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে"।
দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান ও সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, মানুষের মস্তিষ্ক কেবল শৈশবেই বিকশিত হয়। ধারণা করা হতো, ২৫ বছর বয়সের পর মস্তিষ্ক তার নমনীয়তা হারায় এবং অনেকটা 'হার্ডওয়্যার' এর মতো ফিক্সড বা স্থায়ী হয়ে যায়। কিন্তু আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বা নিউরোসায়েন্স এই ধারণাটিকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেছে। আর এই বিপ্লবের নামই হলো নিউরোপ্লাস্টিসিটি।
আজকের এই লেখায় আমরা জানব, কীভাবে আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করছে এবং কীভাবে আপনি এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনকে যেকোনো বয়সে নতুন করে সাজাতে পারেন।
নিউরোপ্লাস্টিসিটি আসলে কী?
সহজ কথায় ভাঙলে, 'নিউরো' অর্থ স্নায়ু বা মস্তিষ্ক এবং 'প্লাস্টিসিটি' মানে নমনীয়তা বা যা আকার পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ, নিউরোপ্লাস্টিসিটি হলো মস্তিষ্কের সেই ক্ষমতা, যার মাধ্যমে এটি অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের গঠন ও কাজ পরিবর্তন করতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্ক কোনো স্থির যন্ত্র নয়, এটি একটি পরিবর্তনশীল অর্গানিজম। আপনি যখনই নতুন কিছু শিখছেন, নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন বা ভিন্নভাবে চিন্তা করছেন, আপনার মস্তিষ্কের ভেতরে গঠনগত পরিবর্তন হচ্ছে।
১৯৪৯ সালে কানাডিয়ান নিউরোসাইকোলজিস্ট ডোনাল্ড হেব একটি বিখ্যাত সূত্র দিয়েছিলেন:
Neurons that fire together, wire together.
আমাদের মস্তিষ্কে বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরন রয়েছে। আমরা যখন কোনো কাজ করি বা কোনো চিন্তা করি, তখন নির্দিষ্ট কিছু নিউরনের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত আদান-প্রদান হয়। এই সংযোগস্থলকে বলা হয় সিন্যাপস।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটছেন। প্রথমবার যখন হাঁটবেন, তখন পথটি দুর্গম থাকবে। কিন্তু আপনি যদি প্রতিদিন একই পথে হাঁটেন, তবে ঘাসগুলো মরে গিয়ে একটি পরিষ্কার রাস্তা তৈরি হবে। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। আপনি যখন বারবার একটি কাজ অনুশীলন করেন বা একই ধরণের চিন্তা করেন, তখন সেই নির্দিষ্ট নিউরাল পাথওয়ে শক্তিশালী ও প্রশস্ত হয়।
বিপরীতভাবে, যদি আপনি কোনো কাজ করা বন্ধ করে দেন, তবে সেই নিউরাল সংযোগটি দুর্বল হয়ে যায়। একে বলা হয় সিন্যাপটিক প্রুনিং বা "Use it or lose it" নীতি।
বয়স কি আসলেই কোনো বাধা?
গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও শৈশবে মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি সবচেয়ে বেশি থাকে, তবে তা কখনোই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। একজন ৭০ বছর বয়সী ব্যক্তিও যখন নতুন কোনো ভাষা শেখেন বা পিয়ানো বাজানো শুরু করেন, তখন এমআরআই স্ক্যানে দেখা যায় যে তার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের গ্রেম্যাটার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস, সারা জীবন নতুন নিউরন তৈরি করতে পারে, যাকে বলা হয় নিউ জেনেসিস।
নিউরোপ্লাস্টিসিটিকে কাজে লাগানোর উপায়
আপনার মস্তিষ্ককে নিজের ইচ্ছামতো গড়ে তোলার জন্য কিছু বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নিচে দেওয়া হলো:
১. অভিনবত্ব বা নতুনত্ব: মস্তিষ্ক যখন রুটিন বা অভ্যস্ত কাজের মধ্যে থাকে, তখন এটি 'অটোপাইলট' মোডে চলে যায়। প্লাস্টিসিটি বা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন চ্যালেঞ্জ।
করণীয়: আপনার ডমিনেন্ট হাত পরিবর্তন করে অন্য হাতে ব্রাশ করা, নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্র শেখা, বা নতুন রাস্তা দিয়ে অফিসে যাওয়া। এই ছোট পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্কে নতুন সংযোগ তৈরি করতে বাধ্য করে।
২. গভীর মনোযোগ: শুধুমাত্র রিপিটেশন বা পুনরাবৃত্তি যথেষ্ট নয়; তার সাথে প্রয়োজন তীব্র মনোযোগ। আপনি যখন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কিছু শেখেন, তখন মস্তিষ্কে 'অ্যাসিটাইলকোলিন' নামক নিউরোমডুলেটর নিঃসৃত হয়, যা নিউরনগুলোকে নির্দেশ দেয় "এটি গুরুত্বপূর্ণ, একে মনে রাখতে হবে"।
৩. শরীরচর্চা ও বিডিএনএফ: অ্যারোবিক এক্সারসাইজ বা কার্ডিও শুধুমাত্র শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও অমৃত। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে BDNF নামক প্রোটিন নিঃসৃত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি মস্তিষ্কের জন্য সারের মতো কাজ করে, যা নতুন নিউরন জন্মাতে ও টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
৪. ভিজুয়ালাইজেশন বা মানসিক মহড়া: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা পিয়ানো বাজানো অনুশীলন করেছেন এবং যারা শুধুমাত্র পিয়ানো বাজানোর কথা কল্পনা করেছেন, উভয় গ্রুপের মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্সে প্রায় একই ধরণের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, গঠনমূলক চিন্তা বা মেন্টাল রিহার্সাল মস্তিষ্কের কাঠামো বদলাতে পারে।
নিউরোপ্লাস্টিসিটির অন্ধকার দিক
নিউরোপ্লাস্টিসিটি সবসময় ইতিবাচক নয়। এটি একটি নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া। আপনি যদি দিনের পর দিন দুশ্চিন্তা, নেতিবাচক চিন্তা বা কোনো বদভ্যাস চর্চা করেন, তবে মস্তিষ্ক সেই নেতিবাচক পথগুলোকেই শক্তিশালী করে তুলবে। একজন ডিপ্রেসড মানুষের মস্তিষ্ক মূলত নেতিবাচক চিন্তার প্যাটার্নে খুব বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে।
তবে সুসংবাদ হলো, যেহেতু মস্তিষ্ক নমনীয়, তাই সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই নেতিবাচক লুপ থেকে বের হয়ে আসাও সম্ভব, একেই বলা হয় কগনিটিভ রিফ্রেমিং।
শেষ কথা
আপনিই আপনার মস্তিষ্কের ভাস্কর। নিউরোপ্লাস্টিসিটির বিজ্ঞান আমাদের একটি বড় বার্তা দেয়, সেটি হলো আশা। আপনার বর্তমান অবস্থা, মানসিক দক্ষতা বা স্বভাব, কোনোটাই পাথরে খোদাই করা নয়। আপনি চাইলেই অধ্যবসায়, নতুন অভিজ্ঞতা এবং সঠিক অভ্যাসের মাধ্যমে নিজের মস্তিষ্ককে নতুন করে ডিজাইন করতে পারেন। আপনি কেবল আপনার জিনের দ্বারা সংজ্ঞায়িত নন; আপনি আপনার অভ্যাসের দ্বারাও সংজ্ঞায়িত। আজ থেকেই শুরু হোক মস্তিষ্ককে নতুন করে গড়ার এই অ্যাডভেঞ্চার।


