মোক্ষ লাভের পথ: মহাভারতের আধ্যাত্মিক মনস্তত্ত্ব

Paths to Awakening

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। চারিদিকে কেবল ধ্বংসস্তূপ, চিতার ধোঁয়া আর স্বজন হারানোর হাহাকার। যুদ্ধের কোলাহল থামলেও, জয়ী যুধিষ্ঠিরের মনের ভেতরে শুরু হয়েছে আরেক মহাযুদ্ধ। বিষাদ, অনুশোচনা আর অস্তিত্বের সংকট তাঁকে গ্রাস করেছে। তিনি বিজয় চান না, তিনি চান শান্তি। তিনি চান মুক্তি।

মহাভারতের 'শান্তি পর্ব' ঠিক এই মানসিক প্রেক্ষাপট থেকেই শুরু হয়। শরশয্যায় শায়িত পিতামহ ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির জানতে চাইলেন যে, এই দুঃখের সাগর পেরিয়ে মানুষ কীভাবে শাশ্বত শান্তির সন্ধান পাবে?

মহাভারত আমাদের শেখায় যে মোক্ষ কোনো মৃত্যু পরবর্তী গন্তব্য নয়; বরং এটি চেতনার একটি বিশেষ স্তর। আসুন, সেই গভীর দর্শনের গভীরে প্রবেশ করি।

১. তৃষ্ণার ক্ষয়: দুঃখের মনস্তাত্ত্বিক উৎস

ভীষ্ম বলেন, তৃষ্ণাই হলো সকল দুঃখের জননী। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, একে আমরা বলি হেডোনিক ট্রেডমিল। আমরা মনে করি, আর একটু বেশি টাকা, আর একটু বেশি সম্মান বা প্রিয় মানুষটিকে পেলেই আমি সুখী হবো। কিন্তু এই আর একটুর কোনো শেষ নেই।

মহাভারতের দর্শন বলে, মোক্ষ তখনই সম্ভব যখন আমরা আমাদের মনের অভাব-বোধ থেকে মুক্তি পাই। আমরা যা চাই, তা না পাওয়াটাই দুঃখ নয়; বরং 'চাই' নামক মানসিক বৃত্তিটিই হলো আসল বন্ধন। মোক্ষ হলো সেই অবস্থা, যখন মন বলে আমার আর কিচ্ছু পাওয়ার নেই, আমি নিজেই নিজের মাঝে সম্পূর্ণ।

২. 'আমি' ও 'আমার' এর গ্রন্থি ছেদন

আধ্যাত্মিক সাইকোলজির সবচেয়ে গভীরতম শিক্ষাটি হলো 'অহং' এর বিশ্লেষণ। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, মানুষ দুটি শব্দে বাঁধা, "মম" (আমার) এবং "ন মম" (আমার নয়)।

"এটি আমার শরীর, এটি আমার রাজ্য, ইনি আমার শত্রু" এই বোধই মানুষকে ক্ষুদ্র করে রাখে।

মোক্ষকামী ব্যক্তি নিজেকে মহাকালের ক্যানভাসে দেখেন। তিনি বোঝেন, তিনি এই বিশাল নাটকের একজন দ্রষ্টা মাত্র, কর্তা নন।

যখন একজন মানুষ বুঝতে পারেন যে তিনি তাঁর চিন্তা নন, তিনি তাঁর শরীর নন, এমনকি তিনি তাঁর আবেগও নন, তখনই তিনি 'জীবনমুক্ত' হন। এই যে নিজের সত্তাকে বস্তু জগত থেকে আলাদা করে দেখার ক্ষমতা, এটাই হলো 'সাক্ষী চৈতন্য'।

৩. কালের ক্যানভাসে নির্লিপ্ততা 

মহাভারত বারবার 'কাল' বা সময়ের অমোঘ শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। যা কিছু আজ আছে, কাল তা থাকবে না। রাজপ্রাসাদ ধ্বংস হবে, যৌবন ফুরোবে, প্রিয়জন বিদেয় নেবে।

সাধারণ লোকেরা এই পরিবর্তনকে ভয় পায়, আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু জ্ঞানী লোক জানে, পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। মোক্ষ মানে সংসার ছেড়ে বনে যাওয়া নয়; মোক্ষ মানে হলো সংসারের অনিত্যতাকে গভীর আলিঙ্গনে মেনে নেওয়া। সাইকোলজির ভাষায় একে বলা হয় 'Radical Acceptance'। যখন আপনি জানেন যে আপনার হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটি একদিন ভাঙবেই, তখন গ্লাসটি ভাঙলে আপনি আর কষ্ট পান না। আপনি প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করেন, কিন্তু কোনো মুহূর্তকে ধরে রাখতে চান না। এই নির্লিপ্ততাই মুক্তি।

৪. সমতা: মনের পরম স্থিতি

ভীষ্মের উপদেশের সারাংশ হলো 'সমতা'। প্রশংসায় যে গলে যায় না, এবং নিন্দায় যে ভেঙে পড়ে না, সেই স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিই মোক্ষের অধিকারী। আমাদের মন সবসময় দ্বন্দ্বে দুলতে থাকে—ভালো/মন্দ, সুখ/দুঃখ। মোক্ষ হলো এই দোলচলের ঊর্ধ্বে ওঠা।

এটা কি অনুভূতির মৃত্যু? না। বরং এটি হলো অনুভূতির গভীরতা। একজন মোক্ষকামী ব্যক্তি সমুদ্রের মতো, যার উপরে ঢেউ ভাঙছে (সুখ-দুঃখ আসছে), কিন্তু তলদেশ সর্বদা শান্ত ও স্তব্ধ। গভীর প্রশান্তির এই স্তরের নামই ব্রহ্মনির্বাণ।

৫. কর্মের নিগড় থেকে মুক্তি: নিষ্কাম ভাব

আমরা যা করি, তা কোনো না কোনো ফলের আশায় করি। এই আশাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মহাভারত এক বৈপ্লবিক সাইকোলজিক্যাল সমাধানের কথা বলে: কর্মফল ত্যাগ।

এর অর্থ কাজ না করা নয়। এর অর্থ হলো, নিজেকে 'কাজের মালিক' না ভাবা। একটি বাদ্যযন্ত্র যেমন জানে যে সুর সে বাজাচ্ছে না, বাজাচ্ছেন একজন বাদক, তেমনি মানুষ যখন নিজেকে মহাজাগতিক শক্তির যন্ত্র হিসেবে সমর্পণ করে, তখন তার আর কোনো ব্যর্থতার ভয় থাকে না। এই 'কর্তৃত্ব-অভিমান' ত্যাগ করাই হলো মোক্ষের চাবিকাঠি।

শেষ কথা: অন্তরের মহাপ্রস্থান

মহাভারতের শেষে পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থান বা স্বর্গের পথে যাত্রা আসলে একটি রূপক। একে একে দ্রৌপদী (আসক্তি), সহদেব (বুদ্ধির অহংকার), নকুল (রূপের অহংকার), অর্জুন (শৌর্য-বীর্যের অহংকার) এবং ভীম (বলের অহংকার) সবাই পড়ে গেলেন। কেবল যুধিষ্ঠির, যিনি ধর্মকে (বিবেক ও সত্য) আঁকড়ে ছিলেন, তিনিই সশরীরে স্বর্গে গেলেন।

আমাদের জীবনের মোক্ষ যাত্রাও তাই। এটি কোনো পাহাড়ে চড়া নয়, বরং নিজের ভেতরকার আসক্তি, অহংকার আর কামনার বোঝা একে একে খসিয়ে ফেলার যাত্রা। যেদিন আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয়, পদবী আর অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে কেবল নিজের অস্তিত্বটুকু নিয়ে শান্তি অনুভব করবেন, সেদিন জানবেন, আপনি মোক্ষের পথে পা বাড়িয়েছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url