মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়
মানুষের জীবনে দুঃখ সাধারণত দুই প্রকার, শারীরিক এবং মানসিক। শারীরিক কারণে মানুষের জীবনে বিভিন্নরকম দুঃখ কষ্ট আসতে পারে, শরীরে কোন রোগ ব্যধি বা সমস্যা দেখা দিলেও দুঃখ পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে যে দুঃখ তা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু মানসিক দুঃখের ক্ষেত্রে সেটি বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, তাই এটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, ফলে আমরা প্রায় সময় মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে ভুল বুঝে থাকি, কিন্তু শারীরিক দুঃখ যেমন যন্ত্রণাদায়ক তেমনি মানসিক দুঃখও একইরকমভাবে যন্ত্রণাদায়ক। তাই শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে।
মূলত আজকে আমরা কিভাবে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করা যায় বা দুঃখ থেকে চিরমুক্তি পাওয়া যায় সেটি নিয়ে আলোচনা করবো।
মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য শারীরিক সুস্থতা আবশ্যক, তবে শুধু শারীরকভাবে ফিট থাকলেই একজন মানুষকে সুস্ত বলা যাবে না বরং শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেই একজন মানুষকে সুস্থ বলা যাবে। মূলত মানসিক সুস্থতা বলতে ব্যক্তির এমন একটি স্বাভাবিক অবস্থাকে বুঝায় যেখানে ব্যক্তি নিজের গুণাবলী সম্পর্কে সচেতন, জিবনের বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করতে সক্ষম এবং নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করতে পারে, এছাড়াও ব্যক্তি পরিবার এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে পারে।
শারীরকভাবে সুস্থ থাকার মানে হচ্ছে শারীরিকভাবে ঠিক মত নিজের কাজকর্ম করতে পারা, শরীরে কোন রোগ ব্যাধি না থাকা, খাবারে রুচি থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হওয়া।
মানসিকভাবে সুস্থ থাকার মানে হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে পারা, কল্পনা করার সক্ষমতা, কোন কিছু মনে রাখতে পারা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা।
এছাড়াও নিজের আবেগ নিয়ন্ত্র করে চলার সক্ষমতাকে আবেগীয় সুস্থতা এবং সামাজিক পরিবেশ বজায় রেখে চলতে পারার সক্ষমতা হচ্ছে সামাজিক সুস্থতা।
তার মানে যে ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় এবং সামাজিকভাবে সুস্থ তাকে আমরা একজন পূর্ন সুস্থ মানুষ বলতে পারি।
অন্যদিকে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যক্তি সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে, মাত্রাতিরিক্ত হতাশাবোধ করে, পড়াশোনা মনোযোগ দিয়ে করতে পারে না, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, ঘুমাতে পারে না, সারাদিন দুশ্চিন্তা করে, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করতে পারে না, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অন্যকে অযথা সন্দেহ করে, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। এধরনের দুই একটি সমস্যা কারো মধ্যে থাকলেই তাকে মানসিক রোগী বলা যাবে না, তবে চারটি, পাঁচটি কিংবা তার বেশি সমস্যা থাকলে তখন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
বিভিন্ন কারণে মানসিক সমস্যা হতে পারে, যেমন - বংশগত কারণে, মস্তিষ্কে বিভিন্ন হরমোননের স্বাভাবিক অবস্থার তারতম্য হলে, মস্তিষ্কে আঘাত পেলে, ঔষুধের প্রভাব, পুষ্টিহীনতা, দুর্ঘটনার স্বীকার, সম্পর্কচ্ছেদ, মাদকাসক্তি, দারিদ্রতা ইত্যাদি।
বর্তমানে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক সমস্যাগুলোও বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ থাকা আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ন তাই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। জীবনকে সুন্দর রাখতে হলে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
মানসিক কষ্ট থেকে উত্তরণের উপায়
১। আধুনিক বিশ্ব যেমন আমাদের নতুন নতুন মানসিক সমস্যা দিয়েছে তেমনি মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণের কিছু সহজ উপায়ও দিয়ে দিয়েছে। যেমন - কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টদের থেকে মানসিক সেবা নিয়ে এবং মাইন্ডফুলনেস কোর্স করেও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায়।
২। আমরা নিজে যখন সমস্যার মধ্যে থাকি তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, তাই তোমার মানসিক সমস্যাটি নিয়ে কারো সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে পারো, এই ক্ষেত্রে অপর ব্যাক্তিটি ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। এছাড়া নিজের সমস্যাটি কারো সাথে শেয়ার করলে তখন নিজের কাছে আর একা মনে হয় না।
৩। নিজের সম্পর্কে কিছু ভাল কথা মনে মনে বললে মস্তিষ্কে ইতিবাচক হরমোন নিঃসরণ হয়, ফলে মেজাজ ভাল থাকে, এটাকে পজিটিভ অ্যাফারমেশন বলে। তাই ইতিবাচক চিন্তার প্র্যাকটিস করতে পারো, যেমন - আমি ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য, আমি একজন দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, আমার মধ্যে পৃথিবীকে সুন্দর করার দক্ষতা রয়েছে, আমি মানুষ হিসেবে মর্যাদাবান এবং এর জন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই, এই ধরনের কথা মনে মনে বলতে পারো।
৪। কখনও অলস বসে থাকবে না। নিজেকে সবসময় কোন একটি ভাল কাজে ব্যাস্ত রাখতে হবে। কোন কিছু করার না থাকলে বই পড়া, বাগান করা, ঘর পরিষ্কার করা অথবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে পারো।
৫। শারীরকভাবে ব্যায়াম করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় রাখতে পারো। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে কিছু পজিটিভ হরমোন তৈরি হয়, এতে ভালবোধ হয় এবং কার্যকরি সিদ্ধান্ত নিতে এটি সাহায্য করে, তাই কখনও খারাপ অনুভব করলে ব্যায়াম করতে পারো, গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষের প্রতিদিন অন্তত ১২ কিলোমিটার হাঁটা প্রয়োজন।
৬। অতিতের কোন স্মৃতি বা ঘটনার কথা যদি বারবার মনে পড়ে এবং সেটি ভেবে খারাপ লাগে তাহলে সেটি একটি খাতার মধ্যে বিস্তারিত লিখে ফেল, কোন কিছু বাদ দিবে না, ঘটনাটি ঘটার কারণ কি, এর জন্য তোমার কোন দোষ রয়েছে কিনা, এরকম একটি ঘটনা অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটলে তাহলে তুমি তাকে কিভাবে সাহায্য করতে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটি লিখে ফেলো তারপর তোমার লেখা কাগজটি ছিঁড়ে ডাস্টিবিনে ফেল দাও।
৭। প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে অন্তত এক মাস মেডিটেশন করতে পারো। মেডিটেশন করার সময় মাথায় নানারকম চিন্তাভাবনার উদয় হবে, এতে বিচলিত হবে না, চিন্তাগুলোকে পর্যবেক্ষন কর, এগুলোকে বিচার করতে যেওনা আবার, শুধু পর্যবেক্ষন করবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে না পারলে আরেকটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারো, শুধু নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দাও। এভাবে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে অন্তত এক মাস মেডিটেশন করে দেখতে পারো।
৮। বিভিন্ন আত্মউন্নয়ন মূলক বই পড়তে পারো, যেমন - একার্ট টোলের 'শক্তিমান বর্তমান'। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন বই, ব্লগ পড়তে পারো। যে ব্যক্তি বেশি বই পড়ে সে সবসময় অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকে। জ্ঞানই শক্তি।
৯। তোমার ভাল সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। কৃতজ্ঞতা মানে হচ্ছে শুকরিয়া আদায় করা। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। যেসব ব্যাক্তি নিয়মিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের মধ্যে ইতিবাচক আবেগ, নতুন জীবনী শক্তি, ভালবোধ, ভাল ঘুম, অন্যের প্রতি দয়া, স্নেহ-মমতা দেখাতে পারা এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি ঘটে ফলে আমাদের মধ্যে ভাল অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
