মহাজাগতিক মহাসমুদ্রের তীরে: এক অনন্ত নক্ষত্রবীথির গল্প
কখনো কি গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করেছেন? মনে হয়েছে, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির মাঝে আমরা ঠিক কোথায়? সত্যটা হলো, আমরা সবাই এক মহাজাগতিক মহাসমুদ্রে ভাসমান যাত্রী, আর পৃথিবী সেই অসীম জলরাশির বুকে ভেসে থাকা অতি ক্ষুদ্র এক ধূলিকণা মাত্র।
কার্ল সেগান যেমনটি বলেছিলেন,
The cosmos is all that is or was or ever will be.
আজ আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছ ব্যস্ততা ভুলে এক কাল্পনিক মহাকাশযানে চড়ে পাড়ি দেব মহাজাগতিক সমুদ্রের তীরে। যেখানে সময় ও দূরত্বের কোনো সীমানা নেই। চলুন, জেনে নিই এই অসীম মহাবিশ্বের কিছু বিস্ময়কর সত্য।
১. মহাবিশ্বের বিশালতা: আমরা কতটা ছোট?
মহাবিশ্বের বিশালতার কথা চিন্তা করলে আমাদের অস্তিত্বকে মনে হয় মহাসমুদ্রে ভাসা অতি ক্ষুদ্র এক পানির ফোঁটার মতো। আমরা যখন রাতের আকাশের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় মহাবিশ্ব বুঝি অনেক বড়। কিন্তু "অনেক বড়" কথাটি দিয়ে এর পরিধি বোঝানো অসম্ভব। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ, আলোর গতিতে ছুটলেও এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে আমাদের ৯৩০০ কোটি বছর লেগে যাবে।
পৃথিবী আমাদের কাছে বিশাল মনে হতে পারে, কিন্তু সূর্যের পেটে এমন প্রায় ১৩ লক্ষ পৃথিবী অনায়াসেই জায়গা করে নিতে পারবে। আবার এই বিশাল সূর্যও আমাদের 'মিল্কি ওয়ে' বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ২০,০০০ থেকে ৪০,০০০ কোটি নক্ষত্রের ভিড়ে অতি সাধারণ একটি নক্ষত্র মাত্র। মহাকাশবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, পৃথিবীর প্রতিটি সমুদ্র সৈকতে যত বালুকণা আছে, মহাবিশ্বে নক্ষত্রের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। আমরা যদি আমাদের পুরো ছায়াপথকে একটি মহাদেশের সাথে তুলনা করি, তবে আমাদের পুরো সৌরজগৎ সেখানে একটি চায়ের কাপের সমানও হবে না।
আমাদের এই ক্ষুদ্রত্ব সবচেয়ে নিদারুণভাবে ফুটে ওঠে ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে ভয়েজার-১ এর তোলা ছবিতে। সেখানে আমাদের এই নীল গ্রহটি শুধুই একটি 'আবছা নীল বিন্দু', যা সূর্যের আলোর একটি আবছা রেখায় ভাসছে। মহাজাগতিক এই বিশাল রঙ্গমঞ্চে আমরা স্থান ও কালের হিসেবে এতটাই নগণ্য যে, মহাবিশ্ব আমাদের উপস্থিতি টেরও পায় না। আমাদের সব ইতিহাস, সব অহংকার, সব যুদ্ধ আর সব ভালোবাসা, সবকিছুই ওই একটি ধূলিকণার মাঝে বন্দী। তবুও, এত ক্ষুদ্র হয়েও অসীমকে জানার এবং বোঝার এই ক্ষমতাই মানুষকে করেছে মহান।
২. নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু
রাতের আকাশে মিটমিট করা নক্ষত্রগুলো আমাদের কাছে চিরস্থায়ী মনে হলেও, মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতোই এদের জন্ম, জীবনচক্র এবং মৃত্যু আছে। একটি নক্ষত্রের গল্পের শুরু হয় মহাকাশের বিশাল গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ বা 'নেবুলা' থেকে। মহাকর্ষ বলের প্রবল টানে যখন এই ধূলিমেঘ ঘনীভূত হয়ে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হয়, তখনই একটি নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়।
কোটি কোটি বছর ধরে আলো ও তাপ বিলিয়ে দেওয়ার পর, যখন নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে আসে, তখন তার অন্তিম লগ্ন উপস্থিত হয়। আমাদের সূর্যের মতো মাঝারি নক্ষত্রগুলো ফুলে ফেঁপে বিশাল লোহিত দানবে পরিণত হয় এবং অবশেষে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে 'শ্বেত বামন' হিসেবে নিভে যায়। কিন্তু বিশাল ভরের নক্ষত্রগুলোর বিদায় হয় অনেক বেশি নাটকীয় ও প্রলয়ংকরী। এরা এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসাবশেষ থেকেই জন্ম নেয় রহস্যময় নিউট্রন তারা কিংবা সর্বগ্রাসী কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল।
তবে নক্ষত্রের এই মৃত্যু আসলে এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলেই নক্ষত্রের গর্ভে তৈরি হওয়া কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও লোহার মতো ভারী মৌলগুলো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই 'নাক্ষত্রিক ছাই' থেকেই পরবর্তীতে পৃথিবী এবং আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ গঠিত হয়েছে। তাই কার্ল সেগান যথার্থই বলেছিলেন, নক্ষত্রের মৃত্যু না হলে আমাদের অস্তিত্বই থাকত না; আমরা আক্ষরিক অর্থেই "নক্ষত্রের ধূলিকণা" দিয়ে তৈরি।
৩. মহাজাগতিক ক্যালেন্ডার
মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১৩৮০ কোটি বছর। এই অকল্পনীয় দীর্ঘ সময়কে মানুষের মস্তিষ্কে ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই কার্ল সেগান এই বিশাল সময়কালকে এক বছরের একটি ক্যালেন্ডারে সংকুচিত করে বুঝিয়েছিলেন, যেখানে ১টি মাস প্রায় ১০০ কোটি বছরের সমান এবং প্রতি সেকেন্ড প্রায় ৪৭৫ বছরের সমান।
এই ক্যালেন্ডারের ১লা জানুয়ারি মহাবিস্ফোরণ বা 'বিগ ব্যাং' এর মাধ্যমে সময়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর মে মাসে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ গঠিত হয়। আমাদের নিজস্ব সৌরজগৎ ও পৃথিবীর জন্ম হয় ৯ই সেপ্টেম্বরের পরে। প্রাণের উদ্ভব সেপ্টেম্বরের শেষে হলেও, ডাইনোসরদের রাজত্ব চলে ডিসেম্বরের ২৫ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হলো মানুষের অবস্থান। আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয় বছরের একদম শেষ দিন, ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫২ মিনিটে। আর আমরা যা কিছুকে 'লিখিত ইতিহাস' বলি, গুহাচিত্র, চাকা আবিষ্কার, পিরামিড নির্মাণ কিংবা আজকের মহাকাশ অভিযান, তার সবকিছুই ঘটেছে ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের পর। অর্থাৎ, মহাজাগতিক সময়ের মহাসমুদ্রে আমাদের পুরো অস্তিত্ব এবং সভ্যতা মাত্র শেষ ১০ সেকেন্ডের গল্প। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মহাবিশ্বের ইতিহাসে আমরা কতটা নবীন অতিথি।
৪. আমাদের ঠিকানা: আবছা নীল বিন্দু
১৯৯০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভয়েজার-১ মহাকাশযান পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে পেছন ফিরে শেষবারের মতো একটি ছবি তোলে। সেই ছবিতে পৃথিবীকে দেখাচ্ছিল এক বিশাল মহাজাগতিক অন্ধকারের মাঝে ভাসমান একটি অতি ক্ষুদ্র 'আবছা নীল বিন্দু' হিসেবে, যা সূর্যের আলোর একটি ক্ষীণ রশ্মিতে আটকে আছে।
এই ছবিটি আমাদের সমস্ত অহংকারকে নিমেষেই চূর্ণ করে দেয়। কার্ল সেগান মনে করিয়ে দেন, ওই ছোট্ট বিন্দুটিই আমাদের ঘর, আমাদের সব আপনজন। ইতিহাসের প্রতিটি রাজা ও প্রজা, প্রতিটি শিকারি ও সংগ্রাহক, প্রতিটি মা ও শিশু, সবাই তাদের জীবন কাটিয়েছে সূর্যের আলোয় ভাসা এই ধূলিকণার ওপর। মহাবিশ্বের এই অসীম শূন্যতায় আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব অন্য কেউ নেবে না; নিজেদেরই এই একমাত্র আশ্রয়স্থলটিকে ভালোবেসে রক্ষা করতে হবে।
৫. মহাকাশের নীরবতা
মহাকাশ এক অনন্ত ও গভীর নীরবতার জগত। এখানে শব্দ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় বায়ু বা কোনো মাধ্যম নেই, তাই মহাজাগতিক প্রলয়গুলো ঘটে নিঃশব্দে। চোখের সামনে কোনো বিশাল নক্ষত্র বিস্ফোরিত হলেও তার কোনো শব্দ আমাদের কানে আসবে না। এক অতল ভুতুড়ে নিস্তব্ধতাই মহাকাশের স্বাভাবিক রূপ।
তবে এই নীরবতা কেবল আমাদের কানের সীমাবদ্ধতা। রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে কান পাতলে এই শূন্যতাই হয়ে ওঠে বাচাল। সেখানে শোনা যায় দ্রুত ঘূর্ণায়মান পালসার নক্ষত্রের হৃৎস্পন্দন, 'বিগ ব্যাং' এর আদিম গুঞ্জন কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষীয় গর্জনের সংকেত। মহাকাশ আপাতদৃষ্টিতে নীরব হলেও, তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের ভাষায় এটি প্রতিনিয়ত তার সৃষ্টির ইতিহাস ও রহস্যের গল্প বলে চলেছে। আমরা কেবল সেই অদেখা সুরের শ্রোতা মাত্র।
শেষ কথা
আমরা মহাজাগতিক সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশু। আমাদের সামনে পড়ে আছে অনন্ত রহস্যের ঢেউ। মহাকাশকে জানার এই যাত্রা আসলে নিজেকেই জানার যাত্রা। আমরা যতই নক্ষত্রের দিকে তাকাই, ততই বুঝতে পারি আমরা একা নই, আমরা এই মহাবিশ্বেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।




