মহাবিশ্বে কি আমরা সত্যিই একা? ফার্মি প্যারাডক্স ও ভিনগ্রহে প্রাণীর সন্ধানে!
গহীন অন্ধকার রাতে আকাশের দিকে তাকালে আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন জাগে এই বিশাল শূন্যতায় আমরা কি সত্যিই একা?
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে। শুধু আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন। গণিতের হিসেবে, এই বিপুল সংখ্যক নক্ষত্রের চারপাশে থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে অন্তত কয়েকটিতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তবুও, মহাকাশ থেকে কোনো সংকেত নেই, কোনো সাড়া নেই। শুধুই এক গভীর নীরবতা।
বিজ্ঞানের ভাষায় এই ভুতুড়ে নীরবতাকেই বলা হয় ‘ফার্মি প্যারাডক্স’। আজকের এই লেখায় আমরা জানব এই প্যারাডক্স এবং ভিনগ্রহের প্রাণী বা এলিয়েনদের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু রোমাঞ্চকর তথ্য।
ফার্মি প্যারাডক্স: সবাই কোথায়?
মহাবিশ্বের দিকে তাকালে এক গভীর নীরবতা আমাদের ঘিরে ধরে। এই নীরবতা থেকেই জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের অন্যতম বড় রহস্য ‘ফার্মি প্যারাডক্স’। ১৯৫০ সালের এক দুপুরে নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি তাঁর সহকর্মীদের সাথে মধ্যাহ্নভোজের সময় হঠাৎ আকাশপানে তাকিয়ে একটি বিখ্যাত প্রশ্ন ছুড়ে দেন, Where is everybody?
ফার্মির এই প্রশ্নের পেছনে যুক্তি ছিল একেবারে গণিতনির্ভর এবং অকাট্য। আমাদের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর এবং শুধুমাত্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই রয়েছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। এর মধ্যে কোটি কোটি নক্ষত্র আমাদের সূর্যের চেয়েও প্রাচীন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বিপুল সংখ্যক নক্ষত্রের চারপাশে পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য গ্রহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
যদি এই গ্রহগুলোর সামান্য কয়েকটিতেও উন্নত প্রাণের বিকাশ ঘটে থাকে, তবে এতদিনে তাদের প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন বছর এগিয়ে থাকার কথা। তারা হয়তো রোবোটিক প্রোব বা মহাকাশযান পাঠিয়ে পুরো গ্যালাক্সি ইতিমধ্যে চষে ফেলার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো আকাশ ভুতুড়েভাবে নীরব। আমরা আজ পর্যন্ত কোনো ভিনগ্রহের মহাকাশযান দেখিনি, কোনো রেডিও সংকেতও পাইনি। 'গাণিতিকভাবে এলিয়েন থাকার উচ্চ সম্ভাবনা' এবং 'বাস্তবে তাদের কোনো প্রমাণ না পাওয়া' এই দুইয়ের মধ্যকার অদ্ভুত বিরোধই হলো ফার্মি প্যারাডক্স।
কেন আমরা তাদের খুঁজে পাচ্ছি না?
বিজ্ঞানীরা এই নীরবতার ব্যাখ্যায় বেশ কিছু ‘থিওরি’ বা তত্ত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি হলো:
১. দ্য গ্রেট ফিল্টার: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রাণের বিবর্তনের পথে এমন কোনো কঠিন বাধা বা ‘ফিল্টার’ আছে যা পার করা প্রায় অসম্ভব। হতে পারে সেই বাধা আমরা পার করে এসেছি তাই আমরা টিকে আছি, অথবা সেই বাধা আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে, হয়তো কোনো মহাপ্রলয়, পারমাণবিক যুদ্ধ বা জলবায়ু পরিবর্তন যা উন্নত সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়।
২. দ্য জু হাইপোথিসিস: চিড়িয়াখানায় আমরা যেমন প্রাণীদের দেখি কিন্তু তাদের খাঁচায় ঢুকে বিরক্ত করি না, হতে পারে উন্নত এলিয়েনরা আমাদের সাথে ঠিক সেটাই করছে। তারা আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক বিকাশে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তারা হয়তো আমাদের জন্য মহাজাগতিক ‘প্রাইম ডাইরেক্টিভ’ মেনে চলছে।
৩. তারা খুব ভিন্ন: আমরা রেডিও সিগন্যাল দিয়ে তাদের খুঁজছি। কিন্তু হতে পারে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম আমাদের কল্পনারও বাইরে। হয়তো তারা টেলিপ্যাথি বা অন্য কোনো ডাইমেনশনে যোগাযোগ করে, যা আমাদের প্রযুক্তি ধরতে পারছে না।
৪. আমরা সত্যিই একা: সবচেয়ে ভয়ংকর সম্ভাবনা হলো, মহাবিশ্বে আমরাই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী। প্রাণের উদ্ভব হওয়া হয়তো এতই বিরল ঘটনা যে এটি কেবল পৃথিবীতেই ঘটেছে।
মানুষের বর্তমান প্রচেষ্টা: আমরা কি হাল ছেড়ে দিয়েছি?
মোটেও না! এলিয়েন সন্ধানে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। 'SETI' বিশাল সব ডিশ অ্যান্টেনায় মহাকাশের রেডিও সিগন্যাল শুনছে। শক্তিশালী 'জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ' দূরের গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডলে ‘বায়ো-সিগনেচার’ বা প্রাণের রাসায়নিক প্রমাণ খুঁজছে। 'মঙ্গলে অভিযান' চালিয়ে নাসা এবং অন্যান্য সংস্থা মঙ্গলে আণুবীক্ষণিক প্রাণের জীবাশ্ম খুঁজছে, যা প্রমাণ করবে যে পৃথিবীর বাইরেও প্রাণ সম্ভব।
শেষ কথা
বিখ্যাত লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক একবার বলেছিলেন:
দুটি সম্ভাবনা আছে: হয় আমরা এই মহাবিশ্বে একা, অথবা আমরা একা নই। এবং দুটি চিন্তাই সমানভাবে ভীতিকর।
যদি আমরা একা হই, তবে এই বিশাল মহাবিশ্বের পুরো দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। আর যদি একা না হই, তবে সেই ‘অন্যরা’ কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য কী, সেটা এক বিশাল রহস্য।
পরের বার আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন তারাগুলোকে মিটমিট করতে দেখবেন, ভাববেন হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনো নীল গ্রহ থেকে, ঠিক আপনার মতোই কেউ একজন আমাদের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে "ওখানে কি কেউ আছে"!
