প্যারালাল ইউনিভার্স: সত্যিই কি আপনার মতো আরেকজন অন্য কোথাও আছে?

Mysterious Parallel Universe

কখনো কি আপনার এমন মনে হয়েছে যে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোনো একটি দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন? মনে হলো, এই ঘটনাটি ঠিক এভাবেই আমার সাথে আগেও ঘটেছে! যাকে আমরা বলি ‘দেজা ভ্যু’। অথবা কখনো কি ভেবেছেন, জীবনের কোনো এক মোড়ে যদি আপনি ‘হ্যাঁ’ এর বদলে ‘না’ বলতেন, তাহলে আজকের জীবনটা কেমন হতো?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, হয়তো সেই ‘অন্য জীবনটি’ আপনার কল্পনায় নয়, বরং বাস্তবেই কোথাও না কোথাও ঘটছে! ওয়েলকাম টু দ্য মিস্টেরিয়াস প্যারালাল ইউনিভার্স, যেখানে আপনি একা নন। হয়তো এই মুহূর্তেই অন্য কোনো মহাবিশ্বে, অবিকল আপনার মতোই দেখতে কেউ একজন এই লেখাটি পড়ছেন, তবে হয়তো তার ভাষা আলাদা, কিংবা তার হাতে ধরা চায়ের কাপটি অন্য রঙের।

কিন্তু এটা কি শুধুই সায়েন্স ফিকশন সিনেমার গল্প, নাকি এর পেছনে আসলেই কোনো বিজ্ঞান বা প্রমাণ আছে? চলুন আজ জানা যাক প্যারালাল ইউনিভার্সের বিজ্ঞান এবং কিছু রহস্যময় ঘটনার কথা।

বিজ্ঞানের চোখে প্যারালাল ইউনিভার্স

সহজ কথায়, মাল্টিভার্স হলো এমন একটি ধারণা যা বলে আমাদের এই মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব নয়। বরং সাবান পানির ফেনার মতো অসংখ্য বুদবুদ বা ‘বাবল’ পাশাপাশি ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি বাবল একেকটি আলাদা মহাবিশ্ব। আর আমাদের মহাবিশ্বের সমান্তরালে থাকা অন্য জগতগুলোকে বলা হয় ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’।

বিজ্ঞানী এবং কসমোলজিস্টরা প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব নিয়ে প্রধানত তিনটি জোরালো তত্ত্ব দিয়েছেন:

১. অসীম মহাবিশ্ব ও ডপেলগ্যাঙ্গার 

মহাবিশ্বের বিশালতা নিয়ে ভাবলে আমাদের মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান এখানে একটি অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা বলে। মহাজাগতিক স্ফীতি বা 'কসমিক ইনফ্লেশন' থিওরি অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্ব যদি সত্যিই অসীম বা অনন্ত হয়, তবে বস্তুকণার বিন্যাস এক সময় না এক সময় পুনরাবৃত্তি হতে বাধ্য। কারণ, একটি নির্দিষ্ট আয়তনে কণা বা অ্যাটমগুলো ঠিক কতভাবে সাজানো যেতে পারে, তার একটি গাণিতিক সীমা আছে।

যখনই মহাবিশ্ব অসীম হয়, তখন সেই সীমিত বিন্যাসগুলো বারবার ফিরে আসে। এর সহজ অর্থ হলো এই মহাবিশ্বের বিশাল দূরত্বের কোনো এক স্থানে ঠিক আমাদের পৃথিবীর মতোই আরেকটি গ্রহ থাকা গাণিতিকভাবে সম্ভব। শুধু গ্রহই নয়, সেখানে হয়তো হুবহু আপনার মতোই দেখতে একজন মানুষ আছেন, যিনি আপনার ‘ডপেলগ্যাঙ্গার’ বা প্রতিমূর্তি।

সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় হলো, সেই ডপেলগ্যাঙ্গারের জীবন আপনার চেয়ে সামান্য ভিন্ন হতে পারে। হয়তো এই পৃথিবীতে আপনি এখন এই লেখাটি পড়ছেন, আর সেই দূরের পৃথিবীতে আপনার ডপেলগ্যাঙ্গার হয়তো একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বা মহাকাশচারী। অর্থাৎ, অসীম মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও আপনার অস্তিত্বের আরেকটি সংস্করণ বেঁচে আছে, যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিছক কল্পনা নয় বরং এক গাণিতিক বাস্তবতা।

২. বাবল ইউনিভার্স 

বাবল ইউনিভার্স' বা বুদবুদ মহাবিশ্বের ধারণাটি এসেছে কসমোলজির ‘ইটারনাল ইনফ্লেশন’ তত্ত্ব থেকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিগ ব্যাং কোনো একক বা একমাত্র ঘটনা ছিল না। মহাবিশ্বের শুরুর দিকে যে দ্রুত প্রসারণ বা ‘ইনফ্লেশন’ শুরু হয়েছিল, তা সব জায়গায় একসাথে থামেনি।

বিষয়টি বোঝার জন্য ফুটন্ত পানির একটি পাত্রের কথা কল্পনা করুন। সেখানে যেমন প্রতিনিয়ত এলোমেলোভাবে নতুন নতুন বুদবুদ তৈরি হয়, মহাকাশেও ঠিক তেমনই ঘটনা ঘটছে। আমাদের পুরো মহাবিশ্বটি হলো এমন একটি বিশাল ‘বাবল’ বা বুদবুদ, যেখানে প্রসারণ ধীর হয়ে নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই বাবলের বাইরে বিশাল শূন্যস্থানে প্রসারণ বা স্ফীতি এখনও চলছে এবং সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মহাবিশ্ব বা ‘পকেট ইউনিভার্স’ জন্ম নিচ্ছে।

সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই ভিন্ন বাবলগুলোতে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। হয়তো পাশের কোনো বাবল ইউনিভার্সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না, কিংবা সেখানে আলো বাঁকা পথে চলে। এই বাবলগুলো একে অপরের থেকে এত দূরে এবং এত দ্রুত সরে যাচ্ছে যে, বর্তমান প্রযুক্তিতে আমরা কখনোই তাদের নাগাল পাব না।

৩. কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও বহু-জগৎ

প্যারালাল ইউনিভার্সের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং অদ্ভুত ধারণাটি এসেছে পদার্থবিজ্ঞানের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে, যা ‘মেনি-ওয়ার্ল্ডস ইন্টারপ্রিটেশন’ নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব আমাদের বাস্তবতার ভিত্তিমূলেই আঘাত করে। পরমাণুর ক্ষুদ্র জগতে একটি কণা একই সময়ে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যখন পর্যবেক্ষণ করি, তখন কেবল একটি নির্দিষ্ট অবস্থাই দেখি। প্রশ্ন হলো, বাকি সম্ভাবনাগুলো কোথায় যায়?

এই তত্ত্বমতে, সেই সম্ভাবনাগুলো হারিয়ে যায় না, বরং মহাবিশ্ব নিজেকে বিভক্ত করে প্রতিটি সম্ভাবনাকে সত্য করে তোলে। বিষয়টিকে একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। ধরুন, আজ সকালে আপনি নীল শার্ট পরবেন নাকি লাল শার্ট, এই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ছিলেন। শেষপর্যন্ত আপনি নীল শার্টটি বেছে নিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাস্তবতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের এই মহাবিশ্বে আপনি নীল শার্ট পরে কাজে গেছেন, কিন্তু ঠিক পাশেই সৃষ্টি হওয়া একটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে আপনারই আরেকটি সত্তা লাল শার্টটি পরেছেন।

অর্থাৎ, আপনার জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় সিদ্ধান্তের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নতুন মহাবিশ্ব বা টাইমলাইন তৈরি হচ্ছে। এর রোমাঞ্চকর অর্থ হলো, কোনো এক জগতে হয়তো আপনি লটারিতে কোটিপতি হয়েছেন, আবার কোনো জগতে হয়তো আপনি আজকের দিনটি দেখার সুযোগ পাননি। সেখানে সব সম্ভাবনাই সমানভাবে সত্য এবং বাস্তবে ঘটছে।

গ্লিচ ইন দ্য প্যারালাল ইউনিভার্স

প্যারালাল ইউনিভার্স কেবল বিজ্ঞানীদের খাতা কলমে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীতে এমন কিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে, যার কোনো লজিক্যাল ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করেন, এগুলো আসলে প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্বের একেকটি ‘গ্লিচ’ বা প্রমাণ। এমন ৪টি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:

১. টরেড থেকে আসা আগন্তুক 

১৯৫৪ সাল। জাপানের টোকিও এয়ারপোর্টে এক ব্যক্তি নামেন। তিনি দেখতে সাধারণ ইউরোপীয়দের মতোই। কিন্তু ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যখন তার পাসপোর্ট চেক করা হলো, কর্মকর্তারা অবাক হয়ে গেলেন। পাসপোর্টে দেশের নাম লেখা ‘টরেড’।

পৃথিবীর মানচিত্রে ‘টরেড’ নামে কোনো দেশ নেই। কর্মকর্তারা তাকে ম্যাপ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তার দেশ কোথায়। লোকটি ফ্রান্স এবং স্পেনের মাঝখানের ‘এন্ডোরা’ নামক ছোট দেশটির দিকে আঙুল দিয়ে বললেন, "এটাই টরেড! হাজার বছর ধরে এই দেশ এখানে আছে"। তিনি অবাক হলেন যে ম্যাপে তার দেশের নাম ভুল লেখা! তাকে সন্দেহের বশে একটি হোটেলে কড়া পুলিশ পাহারায় রাখা হলো। কিন্তু পরদিন সকালে দরজা না ভেঙেও তিনি বদ্ধ ঘর থেকে গায়েব হয়ে গেলেন। তার সাথে থাকা পাসপোর্ট এবং নথিপত্রও উধাও। ধারণা করা হয়, তিনি কি এমন কোনো প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে ভুল করে আমাদের পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন, যেখানে এন্ডোরার নাম আসলে টরেড?

২. লেরিনা গার্সিয়া গর্ডো: ভুল পৃথিবীতে ঘুম ভাঙা

২০০৮ সালে স্পেনের লেরিনা গার্সিয়া গর্ডো দাবি করেন যে, তিনি এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার চারপাশটা ‘একটু অন্যরকম’। তিনি তার অফিসে গিয়ে দেখেন, তিনি যে ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, সেটি সেখানে নেই, যদিও বিল্ডিংটি একই।

সবচেয়ে ভুতুড়ে ব্যাপার হলো তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড গায়েব! তার বদলে বাড়িতে আছেন তার সাবেক প্রেমিক, যার সাথে তার ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। লেরিনা বিশ্বাস করেন, তিনি রাতে ঘুমানোর সময় কোনোভাবে এক ডাইমেনশন থেকে অন্য ডাইমেনশনে ‘শিফট’ হয়ে গেছেন, যেখানে তার জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলো আলাদা ছিল।

৩. কোয়ান্টাম ইমর্টালিটি 

বিজ্ঞানের একটি বিতর্কিত থিওরি হলো ‘কোয়ান্টাম ইমর্টালিটি’। এই থিওরি বলে, মানুষের চেতনা বা কনশাসনেস কখনো মারা যায় না। যখন কেউ কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনায় মারা যায়, তখন তার চেতনা সাথে সাথে পাশের আরেকটি প্যারালাল ইউনিভার্সে স্থানান্তরিত হয় যেখানে সে বেঁচে আছে।

ধরুন, আপনি রাস্তা পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়লেন। এই মহাবিশ্বে আপনি মারা গেলেন। কিন্তু অন্য মহাবিশ্বে ঠিক শেষ মুহূর্তে ড্রাইভার ব্রেক কষল এবং আপনি বেঁচে গেলেন। আপনার চেতনা তখন ‘ইউনিভার্স ২’ এ কন্টিনিউ করবে। ফলে আপনার মনে হবে, "উফ! একটুর জন্য বেঁচে গেলাম"। কিন্তু আসলে আপনি অন্য একটি ইউনিভার্সে মারা গেছেন। অনেক মানুষ ‘নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’ এর পর দাবি করেন, তাদের চারপাশের পৃথিবীটা দুর্ঘটনার পর থেকে সামান্য বদলে গেছে।

৪. দ্য ম্যান্ডেলা ইফেক্ট 

এটি বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের একটি ‘গণস্মৃতির বিভ্রম’। হাজার হাজার মানুষ দাবি করেন, তারা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন যে নেলসন ম্যান্ডেলা আশির দশকেই জেলে মারা গিয়েছিলেন। এমনকি তারা টিভিতে তার শেষকৃত্যও দেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, নেলসন ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালে মারা যান। যারা এই স্মৃতিটি বহন করেন, তারা কি এমন কোনো প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে এসেছেন যেখানে ম্যান্ডেলা সত্যিই জেলে মারা গিয়েছিলেন? নাকি দুটি আলাদা টাইমলাইন কোনো কারণে একে অপরের সাথে মিশে গেছে?

শেষ কথা

প্যারালাল ইউনিভার্সের চিন্তাটি একই সাথে রোমাঞ্চকর এবং ভয়ের। এটি ভাবলে মনে হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব তুচ্ছ। কিন্তু উল্টোভাবেও ভাবা যায়, এই অনন্ত মহাবিশ্বে আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্তের আলাদা গুরুত্ব আছে। আজ আপনি যে ছোট সিদ্ধান্তটি নিচ্ছেন, তা হয়তো অন্য কোনো মহাবিশ্বে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ইতিহাস তৈরি করছে। তাই মহাবিশ্বে আপনার মতো দেখতে অন্য কেউ থাকুক বা না থাকুক, ‘এই মহাবিশ্বের’ আপনি যে অনন্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, আপনি কি নিশ্চিত যে আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি ঠিক আগের পৃথিবীতেই আছেন?

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url