কীভাবে চিন্তা করতে হয়

How To Think by David Foster Wallace

দুটি অল্প বয়সী মাছ একসাথে সাঁতার কাটছিল। একসময় উল্টো দিক থেকে সাঁতরে আসা এক বয়স্ক মাছের সাথে তাদের দেখা। বয়স্ক মাছটি মাথা নেড়ে বলল, সুপ্রভাত। আজকে পানি কেমন?

অল্প বয়সী মাছ দুটি হালকা সাঁতরে অন্যপাশে সরে গেল। তাদের একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই শালার পানি জিনিসটা আবার কী?

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের এই গল্পটি আমাদের জীবনের এক মৌলিক সত্যকে তুলে ধরে: 

আমাদের চারপাশের সবচেয়ে স্পষ্ট, মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাগুলোই আমরা প্রায়ই দেখতে পাই না, কারণ আমরা সেগুলোর মধ্যেই ডুবে থাকি।

আমরা যখন "চিন্তা করা" নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা সাধারণত একে একটি অ্যাকাডেমিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা বলে মনে করি। আমরা ভাবি, শিক্ষা আমাদের জ্ঞান দিয়ে পূর্ণ করে এবং জটিল সমস্যা সমাধান করতে শেখায়। কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষা এর চেয়েও গভীর কিছু। এটা চিন্তা করার ক্ষমতা নিয়ে নয়, বরং কী নিয়ে চিন্তা করব, তা সচেতনভাবে বেছে নেওয়া সম্পর্কে।

আমাদের স্বয়ংক্রিয় 'ডিফল্ট সেটিং'

আমাদের প্রত্যেকের একটি জন্মগত 'ডিফল্ট সেটিং' বা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। তা হলো, গভীর এবং আক্ষরিক আত্মকেন্দ্রিকতা। আমরা প্রত্যেকেই অবচেতনভাবে নিজেদেরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করি। আমাদের ক্ষুধা, আমাদের ক্লান্তি, আমাদের আকাঙ্ক্ষা, এগুলোই আমাদের কাছে সবচেয়ে বাস্তব ও জরুরি।

এই 'ডিফল্ট সেটিং' এর কারণেই প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দৈনন্দিন একঘেয়েমি ও হতাশা আমাদের কাছে এত অসহ্য মনে হয়। 

যেমন: সারাদিন আপনি অফিস করে তারপর মনে হলো বাসায় বাজার নেই, বাজারে যাওয়া দরকার, কাঁচা বাজারে যেতে আপনার ভালো লাগে না, তারপর আবার খলিলের মাংসের দোকানে গিয়ে দেখেন লম্বা সিরিয়াল।

আমাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মনে হয়, সবাই আমার পথ আটকে আছে, এই লোকগুলো কত বোকা আর বিরক্তিকর, কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে? আমরা আমাদের চারপাশের 'পানি' সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন থাকি।

বিশ্বাসের ছাঁচ: আমরা কীভাবে অর্থ তৈরি করি

আমরা কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করি, তা সম্পূর্ণই আমাদের ব্যক্তিগত "বিশ্বাসের ছাঁচ" এর উপর নির্ভরশীল। ওয়ালেস এই বিষয়টি বোঝাতে আরেকটি গল্প বলেন:

আলাস্কার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের বারে দুজন লোক বসে আছে, একজন বিশ্বাসী, অন্যজন নাস্তিক। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে ডিবেট করছে। এক পর্যায়ে নাস্তিক লোকটি বলল, দেখুন, আমি যে বিশ্বাস করি না, তার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি ঈশ্বর ও প্রার্থনার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছি। গত মাসেই আমি এক ভয়ংকর তুষারঝড়ে পথ হারিয়ে ফেলি। তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে, আমি কিছুই দেখতে পারছিলাম না। তখন আমি হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার করে বলি, 'হে ঈশ্বর, যদি তুমি থাকো, আমাকে বাঁচাও, নইলে আমি মারা যাব'।

বিশ্বাসী লোকটি অবাক হয়ে বলল, তাহলে তো তুমি এখন বিশ্বাস করো! কারণ তুমি তো বেঁচে আছো!

নাস্তিক লোকটি হেসে বলল, আরে না! ওটা কিছুই না, শুধু দুজন এস্কিমো সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল আর তারাই আমাকে ক্যাম্পে ফেরার পথ দেখিয়েছিল।

এই গল্পের মূল শিক্ষা কে সঠিক আর কে ভুল, তা নয়। মূল শিক্ষা হলো, একই অভিজ্ঞতা দুজন মানুষের কাছে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে, যা নির্ভর করে তাদের পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসের ছাঁচের ওপর। বিশ্বাসী লোকটি একে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, আর নাস্তিক দেখছেন একে কাকতালীয় ঘটনা হিসেবে।

কিন্তু আসল পয়েন্টটি আরও গভীর। নাস্তিক লোকটি তার নিজের যুক্তিতে ঠিক ততটাই "অন্ধভাবে নিশ্চিত" এবং "সংকীর্ণমনা", যতটা একজন ধার্মিক গোঁড়া হতে পারেন। সে তার নিজের ব্যাখ্যার কারাগারে এমনভাবে বন্দী যে, অন্য কোনো সম্ভাবনার কথা সে চিন্তাই করতে পারছে না।

"চিন্তা করতে শেখা" মানে কি

প্রকৃত শিক্ষা হলো আমাদের এই স্বয়ংক্রিয় 'ডিফল্ট সেটিং' এবং আমাদের সংকীর্ণ "বিশ্বাসের ছাঁচ" সম্পর্কে সচেতন হওয়া। এটা হলো একটু কম অহংকারী হওয়া; আমরা যা কিছুতে নিশ্চিত, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখা।

"চিন্তা করতে শেখা" মানে হলো, আমাদের সেই স্বাধীনতা আছে যে আমরা এই নাস্তিকের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবকিছু বাতিল না করে, সচেতনভাবে অন্য সম্ভাবনাগুলোও বিবেচনা করতে পারি।

যেমন, কাঁচা বাজারে ভিড়ের মধ্যে আমরা আমাদের 'ডিফল্ট সেটিং' এর কারণে বিরক্ত হই, তখন হয়তো আমাদের সামনে কোনো মোটা মহিলা তার বাচ্চাকে পেটাচ্ছেন। আমাদের স্বয়ংক্রিয় চিন্তা তাকে "বিরক্তিকর" বা "খারাপ মা" হিসেবে ভেবে নিবে। কিন্তু এখানেই আমাদের চয়েস করার সুযোগ আছে। আমরা সচেতনভাবে ভাবতে পারি: "হয়তো এই মহিলাটি সাধারণত এমন নন। হয়তো তিনি টানা তিন রাত জেগে তার অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করেছেন। অথবা হয়তো এই মহিলাটিই আপনার নিকটস্থ হসপিটালের সামান্য বেতনের কর্মি, যিনি গতকাল আপনার স্ত্রীকে মেডিকেল টেস্ট করতে সাহায্য করেছিলেন। এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো কম, তবে অসম্ভবও নয়।

চিন্তার এই পছন্দটি বেছে নেওয়ার চর্চা করাই হলো প্রকৃত মানসিক স্বাধীনতা।

জীবনের উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত

ওয়ালেস একটি অদ্ভুত কিন্তু সত্য বিষয় তুলে ধরেন: আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে "নাস্তিকতা" বলে কিছু নেই। উপাসনা না করা বলেও কিছু নেই। সবাই উপাসনা করে। আমরা শুধু কীসের উপাসনা করব, সেই চয়েসটা করতে পারি।

যদি আমরা সচেতনভাবে কোনো মহৎ বা আধ্যাত্মিক কিছুকে আমাদের উপাসনার বস্তু হিসেবে বেছে না নিই, তবে আমাদের 'ডিফল্ট সেটিং' স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য কিছুর উপাসনা শুরু করে দিবে।

আপনি যদি টাকা এবং জাগতিক বস্তুর উপাসনা করেন, তবে আপনার "কখনই যথেষ্ট আছে" বলে মনে হবে না। আপনি যদি নিজের শরীর ও সৌন্দর্যের উপাসনা করেন, তবে আপনি সর্বদা নিজেকে কুৎসিত মনে করবেন। আপনি যদি ক্ষমতার উপাসনা করেন, তবে আপনি সর্বদা নিজেকে দুর্বল এবং ভীত বোধ করবেন।

এই জাগতিক উপাসনাগুলোর সমস্যা এটা নয় যে এগুলো "পাপ"। সমস্যা হলো, এগুলো অচেতন। এগুলো আমাদের 'ডিফল্ট সেটিং' এর ফল। এবং এগুলো আমাদের জীবন্ত খেয়ে ফেলে।

সুতরাং, জীবনের উদ্দেশ্য কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন নয়। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও স্বাধীনতা নিহিত রয়েছে সচেতনতা, মনোযোগ, শৃঙ্খলা এবং অন্য মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থে চিন্তা করতে পারা ও তাদের জন্য প্রতিদিন ছোট ছোট ত্যাগ স্বীকার করার মধ্যে। এটিই আমাদের আত্মকেন্দ্রিক 'ডিফল্ট সেটিং' থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ।

চূড়ান্তভাবে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো সচেতন থাকা। এটি একটি আজীবনের কঠিন সাধনা। উদ্দেশ্য হলো, সেই মাছের মতো না হয়ে, আমাদের চারপাশের 'পানি' সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রতিদিন নিজেদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া: এটাই পানি, এটাই বাস্তবতা, এটাই সত্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url