মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি: ঠিক কীভাবে ধ্বংস হবে আমাদের এই চিরচেনা জগৎ?

The Fate Of The Universe

রাতের আকাশের দিকে তাকালে যে অসীম নক্ষত্ররাজি দেখা যায়, তা দেখে মনে হতে পারে এই মহাবিশ্ব চিরস্থায়ী। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে সব শুরুরই একটি শেষ আছে। ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে 'বিগ ব্যাং' এর মাধ্যমে যে মহাযজ্ঞের শুরু হয়েছিল, একদিন না একদিন তার পরিসমাপ্তি ঘটবেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই শেষটা কেমন হবে? মহাবিশ্ব কি আগুনে পুড়ে শেষ হবে, নাকি জমে বরফ হয়ে যাবে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রধানত চারটি তত্ত্ব বা সিনারিও নিয়ে আলোচনা করেন। চলুন জেনে নিই মহাবিশ্বের এই রোমহর্ষক পরিণতির সম্ভাব্য চিত্রগুলো।

১. দ্য বিগ ফ্রিজ বা হিট ডেথ: এক অনন্ত নীরব সমাপ্তি

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বের পরিণতির সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সম্ভাব্য তত্ত্ব হলো 'দ্য বিগ ফ্রিজ' বা 'হিট ডেথ'। ডার্ক এনার্জির প্রভাবে মহাবিশ্ব বর্তমানে দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই প্রসারণ যদি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে, তবে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে একটি হিমশীতল ও অন্ধকার কবরে পরিণত হবে।

প্রক্রিয়াটি ঘটবে ধীরে ধীরে। মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের থেকে অকল্পনীয় দূরত্বে সরে যাবে। একসময় মহাবিশ্বে নতুন নক্ষত্র তৈরির কাঁচামাল, অর্থাৎ গ্যাস ও ধূলিকণা ফুরিয়ে যাবে। বিদ্যমান নক্ষত্রগুলো তাদের জ্বালানি শেষ করে একে একে নিভে যাবে। তখন মহাকাশজুড়ে কেবল মৃত নক্ষত্র, নিউট্রন স্টার, কৃষ্ণগহ্বর আর অতল অন্ধকার বিরাজ করবে।

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, মহাবিশ্ব যখন 'সর্বোচ্চ এনট্রপি' অবস্থায় পৌঁছাবে, তখন সর্বত্র তাপমাত্রা সমান হয়ে যাবে। তাপের কোনো পার্থক্য না থাকায় তখন আর কোনো কাজ করা বা প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। নাম 'হিট ডেথ' হলেও, এটি মূলত তাপীয় শক্তির মৃত্যুকে বোঝায়, যেখানে তাপমাত্রা পরম শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। কোটি কোটি বছর পর ব্ল্যাক হোলগুলোও বাষ্পীভূত হয়ে যাবে এবং কোনো প্রলয়ঙ্করী বিস্ফোরণ ছাড়াই এক অনন্ত, নীরব ও নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের মৃত্যু ঘটবে।

২. দ্য বিগ ক্রাঞ্চ: মহাজাগতিক সংকোচন ও অগ্নিকুণ্ড

মহাবিশ্বের পরিণতির ক্ষেত্রে ‘দ্য বিগ ক্রাঞ্চ’ তত্ত্বটি ‘বিগ ফ্রিজ’ এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চিত্র তুলে ধরে। এই তত্ত্বটি মূলত মহাকর্ষ বলের বিজয়ের গল্প। বর্তমানে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু যদি মহাবিশ্বে পদার্থের ঘনত্ব যথেষ্ট বেশি হয়, তবে মহাকর্ষ বল একসময় প্রসারণ শক্তি বা ডার্ক এনার্জিকে হারিয়ে দেবে। ফলে একটা পর্যায়ে মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে যাবে এবং উল্টো যাত্রা শুরু হবে।

তখন ইলাস্টিক রাবার টেনে ছেড়ে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে শুরু করবে। গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসবে এবং একের পর এক সংঘর্ষ ঘটবে। মহাবিশ্ব যত ছোট হতে থাকবে, এর তাপমাত্রা তত ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকবে। মহাকাশ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে যে, নক্ষত্রগুলো বাইরের তাপে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।

এই ধ্বংসযজ্ঞের চূড়ান্ত পর্যায়ে সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাক হোল, এমনকি স্থান ও কাল সংকুচিত হয়ে একটি অসীম ঘনত্বের ক্ষুদ্রতম বিন্দুতে বা ‘সিঙ্গুলারিটি’ তে এসে মিলিত হবে। সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে সেই প্রলয়ঙ্করী বিন্দুতে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এই ধ্বংসাবশেষ থেকেই হয়তো আবার নতুন একটি বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে নতুন মহাবিশ্বের জন্ম হতে পারে, যাকে বলা হয় 'দ্য বিগ বাউন্স'।

৩. দ্য বিগ রিপ: মহাজাগতিক ছিন্নভিন্ন দশা

মহাবিশ্বের ধ্বংসের যতগুলো তত্ত্ব আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সহিংস এবং নাটকীয় হলো ‘দ্য বিগ রিপ’। এই তত্ত্বের মূলে রয়েছে রহস্যময় 'ডার্ক এনার্জি'র এক আগ্রাসী রূপ, যাকে বিজ্ঞানীরা 'ফ্যান্টম এনার্জি' বলেন। বর্তমানে ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বকে প্রসারিত করছে, কিন্তু এই তত্ত্বানুযায়ী, সময়ের সাথে যদি ডার্ক এনার্জির শক্তি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে, তবে তা মহাকর্ষসহ প্রকৃতির সব মৌলিক বলকে পরাজিত করবে।

এই ধ্বংসযজ্ঞ ধাপে ধাপে ঘটবে। প্রথমে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা ছায়াপথপুঞ্জগুলো একে অপরের থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে। এরপর প্রসারণ শক্তি এতটাই তীব্র হবে যে, তা গ্যালাক্সিগুলোর নিজস্ব মহাকর্ষ বলকে ভেঙে ফেলবে, ফলে নক্ষত্রগুলো ছিটকে যাবে। ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে আমাদের সৌরজগতের মতো সিস্টেমগুলো ভেঙে পড়বে; পৃথিবী সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

‘দ্য বিগ রিপ’এর চূড়ান্ত মুহূর্তটি হবে সবচেয়ে রোমহর্ষক। মহাজাগতিক প্রসারণ শক্তি শেষমেশ পরমাণুর ভেতরের বন্ধনও ছিঁড়ে ফেলবে। অণু, পরমাণু, এমনকি ইলেকট্রন ও প্রোটনের মতো অতিপারমাণবিক কণাগুলোও একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আক্ষরিকভাবেই মহাবিশ্বের স্থান কালের কাঠামো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, আর প্রতিটি কণা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক অনন্ত একাকীত্বে হারিয়ে যাবে।

৪. ভ্যাকুয়াম ডিকে: মহাজাগতিক বুদবুদ ও আকস্মিক বিলুপ্তি

মহাবিশ্বের ধ্বংসের সবচেয়ে আকস্মিক এবং ভীতিকর তত্ত্বটি হলো 'ভ্যাকুয়াম ডিকে'। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণা অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্ব সম্ভবত একটি 'ফলস ভ্যাকুয়াম' বা অস্থিতিশীল শক্তিস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সহজ কথায়, মহাবিশ্ব অনেকটা খাদের কিনায় আটকে থাকা একটি পাথরের মতো স্থিতিশীল মনে হলেও, এটি আসলে তার সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে পৌঁছায়নি।

যদি মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে একটি কণাও তার প্রকৃত সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে চলে যায়, তবে সেখানে একটি মহাজাগতিক 'বুদবুদ' তৈরি হবে। এই বুদবুদটি আলোর গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং এর সামনে যা কিছু আসবে গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি সব গ্রাস করে নেবে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, এই বুদবুদের ভেতরে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলো (যেমন ভর বা বলের প্রকৃতি) সম্পূর্ণ বদলে যাবে। ফলে রসায়ন এবং প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে পড়বে।

যেহেতু এই ধ্বংসযজ্ঞ আলোর গতিতে ধেয়ে আসবে, তাই আমরা এটি আসার কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কবার্তা পাব না। আমরা আকাশ দেখে ভয় পাওয়ার সুযোগও পাব না; কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে অস্তিত্বহীন হয়ে যাব। এটি হবে মহাবিশ্বের এক যন্ত্রণাহীন, কিন্তু নিশ্চিত এবং তাৎক্ষণিক বিলুপ্তি। এটি অনেকটা কম্পিউটারের ডিলিট বাটন চাপার মতো।

শেষ কথা

এই সবকটি সম্ভাবনাই তাত্ত্বিক এবং এগুলো ঘটতে এখনো বিলিয়ন বিলিয়ন বছর বাকি। মানবজাতি ততদিন টিকে থাকবে কি না, সেটাই বরং বড় প্রশ্ন। তবে মহাবিশ্বের এই বিশালতা এবং তার পরিণতির কথা ভাবলে নিজেদের খুব ক্ষুদ্র মনে হয়, যা আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে আরও সুন্দরভাবে উপভোগ করার কথা মনে করিয়ে দেয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url