উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত
২১ জুলাই সোমবার, জনবসতিপূর্ণ এলাকা ঢাকার উপর দিয়ে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের বিমানটি চালাচ্ছিলেন লেফটেনেন্ট পাইলট তৌকির। এটি তার প্রথম একক ফ্লাইট ছিল।
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে তখন বাচ্চাদের ক্লাস চলমান ছিল। ছোট ছোট শিশুরা গান গাচ্ছিল "একদিন ছুটি হবে- অনেক দূরে যাবো"।
ঠিক দুপুর ১ঃ১৮ টায়, মাইলস্টোন স্কুলে সেই ক্লাস ভর্তি শিশুদের উপর যুদ্ধবিমানটি ক্র্যাশ করেন তৌকির।
এতে সাথে সাথে সেই জায়গায় বিস্ফোরণ হয়। চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশে যারা ছিল তীব্র আগুনের তাপে শরীরের মাংস পুড়ে যায়। অনেকেই সাথে সাথে পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়। আবার অনেকেই পোড়া শরীর নিয়ে বাইরে বের হয়ে পড়ে। তাদের চুল, মুখমণ্ডল এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে যায়। ভিডিওতে দেখা যায় শরীর থেকে চামড়া খসে পড়তেছিল। পাশে গার্ডিয়ানরা চিৎকার করে কান্না করছিল। কি এক নির্মম দৃশ্য।
প্রায় সাথে সাথে উদ্ধারকর্মী টিম এবং সেনাবাহিনী চলে আসে। অ্যাম্বুলেন্স এবং হেলিকপ্টারে করে বাচ্চাদের নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাচ্চারা তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে।
মানুষের এই বিপদের সময় তৃতীয় শ্রেণির লোকগুলো তখন হায়েনার মত হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হয়ে যায়, রিক্সাওয়ালা তখন ২০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা চায়, সিএনজিওয়ালা ৫ মিনিটের রাস্তা ১০০০ টাকা ভাড়া চায়, ২০ টাকার পানি ১০০ টাকা হয়ে যায়, ক্যান্টিন বন্ধ করে ফেলে যদি পানির বিল না দেয় কেউ। মানুষ বিপদে পড়বে, আবার বিপদে একে অন্যকে সাহায্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বাংলাদেশে আপনি বিপদে পড়লে দুঃখ আছে। এখানে মানুষের ক্রাইসিসের সময় তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়। অথচ এদের জন্য আমরা কত মায়া দেখাই।
লেফটেনেন্ট তৌকিরের দেহ পাওয়া যায় বিমানের বাইরে। সে বিমান থেকে ইজেক্ট করেছিল। বাঁচার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিমানটি এত দ্রুত পতিত হয় যে ইজেক্ট করেও লাভ হয়নি। সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। তাকে সিএমএইচ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বন্ধু সাইদ আব্দুল্লাহ জানান তৌকির এখনো বেঁচে আছে।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চলতে থাকে। প্রায় ৫০ শিশু নিহত হয় এবং প্রায় ২০০ শিশু আহত হয়। মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষিকাও আহত হয়।
একজন শিক্ষিকা "মেহেরিন চৌধুরি" তিনি প্রায় ২০ জন স্টুডেন্টকে সেইফ করেন। কিন্তু বাচ্চাদের উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি নিজেই আগুনে দগ্ধ হন। উনার স্বামী মনসুর সাহেব উনাকে হসপিটালে দেখতে যান, মেহেরিন স্বামীর হাত বুকে নিয়ে বলেন "আমি চলে যাচ্ছি, আর দেখা হবে না"। হাতগুলো পুড়ে গিয়েছিল উনি ঠিকভাবে ধরতে পারছিলেন না, মনসুর সাহেব উনাকে জিজ্ঞেস করেন 'তোমার তো নিজেরও দুইটা সন্তান আছে তাদের এতিম করলে কেন'? তিন বলেন 'ওরাও (স্টুডেন্ট) তো আমার সন্তান, ওদের একা ফেলে কীভাবে আসি'। এই কথা শুনে মনসুর সাহেব কেঁদে ফেলেন।
এদিকে ফেসবুকে একটি গল্প ছড়িয়ে পড়ে যে পাইলট তৌকির সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল স্কুলের শিশুদের রক্ষা করতে কিন্তু এটি সত্য নয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মনে হয়, উপর থেকে কোনো ভারি বস্তু ফেলে দিলে যেভাবে এটি সোজা নিচে পড়ে যায়, ঠিক সেভাবে বিমানটি স্কুলের উপর আছড়ে পড়ে। পাইলটের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখার পরেও বিমানটি নিয়ে বেইজে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এটা না করে যদি তখনই কোনো খালি জায়গায় নিয়ে ইজেক্ট করতো তাহলে হয়ত এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। পাইলট তৌকির নিজে তো মরলো সাথে কতগুলো নিষ্পাপ শিশুর জীবন নিয়ে নিলো। অনেকেই দেখা যায় প্রশিক্ষিত বিমানে সমস্যা দেখা দিলে ধান খেতে নিয়ে ক্র্যাশ করে। এরা হচ্ছে আসল হিরো। এরা মরলে একাই মরবে, এদের কাছে অন্যদের জীবনের মূল্য আছে।
এদিকে আহতদের দেখার জন্য বিকালেই জামাতের আমির শত শত নেতাকর্মীদের নিয়ে হসপিটালে ভিড় করেন। তার দেখাদেখি বিএনপির নেতা রিজভিও সেখানে আহতদের দেখতে যায়। এদের সেইখানে কোনো কাজ নাই, শুধু শুধু গিয়ে ভিড় সৃষ্টি করে চিকিৎসা সেবায় ব্যাঘাত ঘটায়।
বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুইদিন নানা রকম ইস্যু চলতে থাকে। আমাদের ডক্টর ইউনুস সাব ফেসবুকে আহত/নিহতদের জন্য ফান্ড খুলে ভিক্ষা চেয়ে পোস্ট করেন। পাবলিকের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে পোস্টটি আবার ডিলিট করে ফেলেন। এমন একটা সময়ে, যখন হসপিটালে শিশুরা মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, ইউনুস সাবের এইরকম ফান্ড খোলার মত ছোটলোকি কাজ করা ঠিক হয়নি।
এই নিহত শিশুদের কোনো গার্ডিয়ানরা কি টাকা চেয়েছিল তখন? টাকা দিলে কি তাদের বাচ্চাদের ফিরে পাবে? আর টাকা দিলেও তার জন্য পাবলিকের কাছে খয়রাত করতে হবে কেন একজন সরকার প্রধানকে? সরকারি ফান্ডে কি টাকা কম আছে?
এর মধ্যে একটা গুজব ছড়ায় যে, ফেসবুকে একটা এনোনিমাস পেইজ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল এইরকম একটা ঘটনা ঘটবে। তারা একটি পোস্ট করেছিল 'কোথাও একটা স্কুলের বিল্ডিংয়ে হামলা হবে...'। কিন্তু এইটা একটা ভুয়া পোস্ট ছিল। সেইখানে কোনো দেশের নাম উল্লেখ ছিল না। আবার তারা দাবি করেছিল বিল্ডিংয়ের বাজে মেইন্টেনেন্সের কারণে এই হামলাটা হবে। কিন্তু মাইলস্টোন স্কুলের বিল্ডিং সংক্রান্ত কোনো ইস্যু ছিল না। আওয়ামীলীগের নিম্ন শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আজম খানেরা এইটকে ইস্যু বানাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ রিপোর্ট মেরে ঐ পেইজটাকে ডিজেবল করে ফেলে।
২২/২৩/২৪ তারিখের এইচএসসি এবং বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তবে স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয় রাত ৩টায়। অনেকে সকালে জানতে পারে। তারপরেও অনেক শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের সামনে গিয়ে আন্দোলন করে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে। এতে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করা হয়। সচিবালয়ের সামনে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের মারমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাকি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীরাও ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। উত্তরায় দুই উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা তাদের ভুয়া স্লোগান দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তারা একটি বিল্ডিংয়ের ভিতরে আশ্রয় নেয়। পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের ঝামেলা হলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। এতে শিক্ষার্থীরা রেগে গিয়ে পুলিশের উপর ইট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। দুই উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল সেখানে প্রায় ৯ঘণ্টা যাবত বন্ধী ছিল। সন্ধ্যার দিকে তারা বের হতে পারে।
২৩/২৪ তারিখ আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। যদিও এইটা স্থগিত করার দরকার ছিল না। তবে আমার জন্য ভালোই হয়েছে। ফেসবুকে এইসব নিউজ দেখে, বাচ্চাদের কষ্ট দেখে আমি প্রায় ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছি, পড়াশোনা কিছুই করতে পারিনাই এই দুই দিন, আমার শুধু নিজের ভাতিজা/ভাগ্নিদের কথা মনে পড়তেছিল, ঐ জায়গায় যদি ওরা কেউ থাকতো, তাহলে আমাদের পরিবার কীভাবে এই শোক বহন করতো। মাইলস্টোন স্কুলে যেসব শিশুরা নিহত/আহত হয়েছে তারাও তো কোনো পরিবারের সন্তান, তাদের বাবা-মা, তাদের পরিবারের মানুষেরা এই কষ্ট কীভাবে বহন করছে। না জানি তাদের কতটা কষ্ট হচ্ছে। তারা এখন কীভাবে বাঁচবে। এইসব ভাবতেই মনে হচ্ছে কোথাও পালিয়ে যাই আমি। এই নরক থেকে অনেক অনেক দূরে।